প্রতিনিধি খুলনা
ভৈরব আর রূপসার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরে গত শতকের ষাটের দশকে গড়ে উঠেছিল একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গত বৃহস্পতিবার খুলনা নগরের খানজাহান আলী সেতু এলাকা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
খুলনার নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সারি সারি শিল্পকারখানা, শ্রমিকের কর্মব্যস্ত মুখ আর অর্থনীতির গতিময় চাকা। পাটকলের সাইরেন, নিউজপ্রিন্ট মিলের অবিরাম ঘূর্ণি আর ছোট-বড় কারখানার অবিরাম কোলাহলের মধ্যেই ছিল খুলনার পরিচয়। এ শহর শুধু ইট-পাথরের সমষ্টি ছিল না; ছিল উন্নত জীবনের সন্ধানে আসা স্বপ্নবাজ মানুষের ঠিকানা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আশায় বুক বেঁধে এখানে আসত। খুলনা হয়ে উঠেছিল তাদের আশ্রয়, তাদের জীবিকার উৎস।
আবুল কালাম সামসুদ্দিন তাঁর শহর খুলনার আদি-পর্ব বইয়ে খুলনাকে স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৮৭৫–৭৬ সালের দিকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সুন্দরবনের গুরুত্ব ও ভূমিকা সরকারের কাছে অনুভূত হতে থাকে। বাংলার গভর্নর রিচার্ড টেম্পল সুন্দরবনের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করে অনুভব করেন, সুদূর যশোর বা ২৪ পরগনা থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা খুব দুরূহ। এর আগেও এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজস্ব ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে সুন্দরবন বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র জেলা গঠনের চিন্তাভাবনা চলছিল। অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্য ও যাতায়াতের দ্রুততার জন্য রেলপথ সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব কারণে সুন্দরবন এলাকার শাসনকার্যের সুবিধার্থে ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা এবং ২৪ পরগনা জেলা থেকে সাতক্ষীরা মহকুমাকে পৃথক করে খুলনাকে স্বতন্ত্র জেলায় পরিণত করা হয়।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই খুলনাকে সারা দেশ চিনেছে তার শিল্পের ঐশ্বর্যে। আশির দশকেও এই শহরের কারখানা ঘিরে ছিল হাজারো মানুষের ব্যস্ততা। ১১৩ একরের খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল আকার ও শ্রমিকসংখ্যার দিক দিয়ে ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাটকল। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠার পর ৭০ বছর এই পাটকল বহু শ্রমিকের জীবিকা জুগিয়েছে। ২০২০ সালের জুলাইয়ে বন্ধের সময় এখানে প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। ক্রিসেন্ট মিলের প্রধান ফটকের পাশে টাইলসের বেদি—যেন এক নীরব স্মৃতিস্তম্ভ। ধুলার পুরু আস্তরণ জানান দিচ্ছে, কতকাল এখানে কোনো পদচিহ্ন পড়েনি, বসেনি কোনো ক্লান্ত শ্রমিক। একসময়ের কর্মচাঞ্চল্যমুখর আঙিনা এখন খাঁ খাঁ করে, স্তব্ধতার অচেনা সুর যেন বিষণ্ন গান গায়।
শুধু ক্রিসেন্ট নয়, খুলনার অনেক পাটকলই এখন বন্ধ। শুধু পাটকল কেন, আরও অনেক কারখানায় উৎপাদন নেই। সব মিলিয়ে শিল্পের শহর খুলনার কারখানায় কারখানায় এখন নীরবতা, নিস্তব্ধতা। বন্ধ দরজার ওপারে স্তব্ধ হয়ে আছে একসময়ের কর্মমুখর প্রাঙ্গণ।
১৯৮৬ সালে বদলি শ্রমিক হিসেবে ক্রিসেন্টের আঙিনায় পা রেখেছিলেন রতন কুমার মণ্ডল। গত বসন্তে একদিন মিলের ভেতর দাঁড়িয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে রতন বলেন, ‘ক্রিসেন্টের বিশাল প্রান্তরে মাইকের সুরে ফুটবলের উন্মাদনা ছিল যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। কারখানার ভেতরেই সবকিছু—যেন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ জগৎ। আজ সেই চেনা ছবি উধাও, খাঁ খাঁ করছে চারপাশ, কথা বলারও যেন কেউ নেই।’
খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিল আকার ও শ্রমিকসংখ্যার দিক দিয়ে ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাটকল | ফাইল ছবি |
ক্রিসেন্ট জুট মিল পেরিয়ে বিআইডিসি সড়কের এক কিলোমিটারের দূরত্বে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল। কালের সাক্ষী শ্রমিক কলোনির সারি সারি ভবন যেন বেদনার নীরব প্রতিচ্ছবি। প্লাটিনামের ১ নম্বর ফটকের ঠিক বাইরে ‘বরিশাল স্টোর’ নামের এক ক্ষুদ্র দোকানের মালিক শামসুল আলম। ১৯৭৯ সালে চুয়াডাঙ্গার মাটি ছেড়ে খুলনার কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন তিনি। পাঁচ সন্তানের আশ্রয় ছিল এই কলোনি। শামসুল আলম বলেন, আগে প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল যেন এক ঈদ উৎসব। শ্রমিকেরা সেদিন বেতন পেতেন, আর এখানকার দোকানে লেগে থাকত উৎসবের আমেজ। কেনাবেচার ধুম পড়ে যেত।
খুলনার মীরেরডাঙ্গা এলাকার সোনালী জুট মিল, অ্যাজাক্স জুট মিল, আটরা শিল্পাঞ্চলের আফিল জুট মিল, শিরোমণি বিসিক শিল্প এলাকার মহসিন জুট মিলসহ বেসরকারি অনেক পাটকলই যেন শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একসময়ের ২৪ ঘণ্টা মুখর থাকা খুলনা শিল্পাঞ্চল যেন এখন নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া থাকে।
শিল্পের উত্থান আর পতনের বাঁক
ভৈরব আর রূপসার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরে গত শতকের ষাটের দশকে গড়ে উঠেছিল একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫২ সালে খালিশপুরে ক্রিসেন্ট ও পিপলস জুট মিলের হাত ধরে সূচিত হয়েছিল এই অঞ্চলের শিল্পের সোনালি অধ্যায়। এরপর একে একে দৌলতপুর, প্লাটিনাম, স্টার জুট মিলের মতো বৃহৎ কারখানা খুলনাকে পরিণত করেছিল প্রাচ্যের ডান্ডিতে। এ ছাড়া স্বাধীনতার আগে ইস্টার্ন জুট মিল, আলিম জুট মিল, আফিল জুট মিল, মহসিন জুট মিল, সোনালী জুট মিল ও অ্যাজাক্স জুট মিল স্থাপিত হয়। পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা ও পরে পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় সব কারখানা ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়।
শুধু পাট নয়, এখানে বিকশিত হয়েছিল নিউজপ্রিন্ট ও হার্ডবোর্ডের মতো রাসায়নিক শিল্পও। ১৯৫৯ সালে ভৈরব নদের তীরে স্থাপিত হয় খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানা। সেখানে দিন-রাত আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। কারখানার পাশে ১৯৬৫ সালে দেশের একমাত্র সরকারি হার্ডবোর্ড কারখানাটি স্থাপিত হয়। কানাডার অনুদানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা কারখানাটি স্থাপন করে। কয়েকবার বন্ধ-চালুর পর ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
খুলনায় ভারী শিল্পের ইতিহাস জানাতে গিয়ে গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, খুলনায় পাটকল হওয়ার অনেক আগে থেকেই দৌলতপুরে পাটের বড় মোকাম ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সরকার শিল্প স্থাপনের জন্য উদারহস্তে জমি বরাদ্দ দেয়, সেই সঙ্গে সহজ শর্তে ঋণ ও ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করে। প্রথম দিকে পাকিস্তানি উদ্যোক্তারাই ছিলেন প্রধান চালিকা শক্তি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আশির দশকে খুলনা ছিল জমজমাট, ব্যবসাও ছিল চাঙা। নব্বইয়ের দশক থেকে একের পর এক কারখানায় বন্ধের বাতাস বইতে শুরু করে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বন্ধ হয় খুলনা টেক্সটাইল মিল। সেটি ছিল ভারী শিল্প বন্ধের প্রথম ঘটনা। এরপর একে একে রাষ্ট্রায়ত্ত হার্ডবোর্ড, নিউজপ্রিন্ট ও রূপসার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০২০ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে যেন শিল্পনগরের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়।
সরকার পাঁচ বছর আগে বন্ধ পাটকলগুলো আধুনিকায়নের স্বপ্ন দেখালেও তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কিছু কারখানা ইজারা দেওয়া হলেও উৎপাদন সেই পুরোনো দিনের ধারেকাছেও নেই। শ্রমিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনগুলো সরকারি মালিকানায় কারখানা চালুর দাবিতে আজও রাজপথে স্লোগান তোলে। গত বুধবার বিকেলে ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু ও টেন্ডারের নামে লুটপাট বন্ধের দাবিতে খুলনা নগরের খালিশপুরে প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিল ও খালিশপুর জুট মিলে মানববন্ধন করেছেন শ্রমিকেরা। সেখানে শ্রমিকদের কর্মসূচিতে প্রধান বক্তা ছিলেন খুলনা নগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
জরাজীর্ণ খুলনা হার্ডবোর্ড মিল | ফাইল ছবি |
শ্রমিকদের কর্মসূচিতে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন বলেন, ‘একসময় খুলনার নাম উঠলেই আরেকটি শব্দ যুক্ত হতো, সেটি হলো শিল্পনগরী খুলনা। কিন্তু সেই শিল্পনগরী এখন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিগত ১৬ বছরের দুঃশাসন, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিতে ধ্বংস হয়ে গেছে রূপসা-ভৈরবতীরের চিরচেনা শিল্পনগরী। যেখানে ২৪ ঘণ্টা শ্রমিক-কর্মচারীর কোলাহলে মুখর থাকত, আজ সেসব জায়গায় সুনসান নীরবতা।
শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খুলনার শিল্পকারখানাগুলোর এই করুণ পরিণতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিষবৃক্ষ। কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব, লাগামছাড়া পরিচালন ব্যয় এবং সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে লোকসান ক্রমে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের চাপানো নীতিও এই শিল্প ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অনেকে।
শিল্পের এই বিপর্যয় শুধু শ্রমিকদের জীবনকেই দুর্বিষহ করে তোলেনি, বরং এর প্রভাব পড়েছে শহরের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনেও। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, নতুন বিনিয়োগের অভাব এবং একসময়ের সমৃদ্ধিশালী খুলনার পরিচিতি হারানোর বেদনা—সব মিলিয়ে এক বিবর্ণ বাস্তবতার মুখোমুখি এই শহর।
শিল্পনগরীর তকমা হয়তো আর আগের মতো উজ্জ্বল হবে না, কিন্তু সমন্বিত চেষ্টায় খুলনা ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে—এমনটাই বিশ্বাস এখানকার মানুষের।