নোমান মিয়া

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লাল মামার টং’। ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীরা সেখানে আড্ডায় মেতে ওঠেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি ছোট্ট ঝুপড়ি দোকান। ক্যাম্পাসের সবাই এটিকে ‘লাল মামার টং’ নামে চেনে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বর–সংলগ্ন যাত্রীছাউনির পাশেই দোকানটি। চায়ের কাপ হাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আড্ডায় নিয়মিত মুখর থাকে দোকানটি। আলোচনায় উঠে আসে সমকালীন রাজনীতি, পরিবেশ, গবেষণা কিংবা নানামুখী বিতর্ক। ক্লাসের ফাঁকে বা বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে সম্মিলন ঘটে বহু চিন্তার।

কিন্তু এসব চিন্তা কিংবা আড্ডার বাইরেও লাল মামার টংদোকানটি কীভাবে গড়ে উঠেছে, সেটির আছে ভিন্ন গল্প। আছে চা বিক্রি করে জীবন-জীবিকা চালিয়ে নেওয়ার এক সংগ্রামের চিত্র।

দোকানটির মালিক অজয় আচার্যের বয়স ৫৫ ছুঁই ছুঁই। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে নিজ হাতে চা, বিস্কুট ও পান বিক্রি করে তিনি ক্যাম্পাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন। অজয়ের ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। সেখানে চার-পাঁচ বছর চা বিক্রি করেছিলেন। এরপর ২০০০ সালে ক্যাম্পাসে এসে টংদোকান দেন। প্রথম দিকে দোকান ছিল মুক্তমঞ্চের কাছে, পরে স্থানান্তরিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যারেজের পাশে। ১০ বছর ধরে দোকানটি বর্তমান স্থানে আছে। ক্যাম্পাসে তিনিই প্রথম টংদোকান স্থাপন করেন। শুরুর দিকে অন্যরা ঠেলাগাড়িতে করে চা-বিস্কুটসহ নানা পণ্য বিক্রি করতেন।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অজয় আচার্য শিক্ষার্থীদের কাছে ‘লাল মামা’ নামে পরিচিত | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

২০০৮ সালে অজয় আচার্যের দোকান লাল রং করানোর পর থেকেই তাঁকে সবাই ‘লাল মামা’ নামে চিনতে শুরু করে। তবে তাঁর প্রকৃত নাম অনেকেরই অজানা। এই রঙিন দোকান শুধু একটি দোকান নয়, বরং পুরোনো অনেক গল্পের অংশ। চা তৈরি করতে করতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি।

অজয় আচার্য বলেন, ব্যবসার শুরুতে এক কাপ চা বিক্রি হতো মাত্র এক টাকায়। সময়ের সঙ্গে চাহিদা ও আগ্রহের পরিবর্তনে দাম ধাপে ধাপে বেড়ে ২, ৩, ৫, ৬, ৭ হয়ে এখন ১০ টাকায় পৌঁছেছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত মানুষের পছন্দ ছিল দুধ চা, এর পর থেকে রং চায়ের চাহিদা বাড়ে। এই পরিবর্তনের ধারাতেই দোকানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর টংদোকানে দৈনিক দু–তিন হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। ক্যাম্পাস খোলা থাকলে লাভ থাকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। তবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বা ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলে লাভ হয় না। বছরের অনেকটা সময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে। তখন কষ্ট করেই চলতে হয়।

অজয় আচার্যের পৈতৃক বাড়ি সুনামগঞ্জ সদরের জয়পাড়ায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সুনামগঞ্জ সদরের জয়পাড়ায় অজয় আচার্যের পৈতৃক বাড়ি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন নয়াবাজার এলাকায় তিনি বসবাস করছেন মা, স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে। বড় ছেলে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। কষ্ট করেই ছেলেদের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মামারা (শিক্ষার্থীরা) অনেক ভালো। মাঝেমধ্যে তাঁরা আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। কেউ কেউ আমার ছেলেদের পড়াশোনাও করান।’ তিনি আরও বলেন, ‘১০ বছর বয়সেই আমার বাবা মারা যান। এরপর পারিবারিক সংগ্রামে টিকে থাকতে কাজ শুরু করতে হয়। ছোটবেলা থেকে চা-বিস্কুটের ব্যবসা করেই সংসার চলছে। এই ব্যবসাই আমার একমাত্র অবলম্বন। আমার দোকানে জোর করে কেউ কখনো বাকি নেয়নি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এসে যে জায়গাটা সবচেয়ে আপন মনে হয়েছে, সেটা লাল মামার টং। চায়ের সঙ্গে মামার হাসিমাখা কথা আমাদের ভালো লাগে। দিনের অনেকটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে সেখানেই আড্ডা দিই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া অনেক সিনিয়রের সঙ্গেও কথা হয়। তাঁরাও লাল মামার কথা বলেন, খোঁজ নেন।’