নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাদ এলাকার এই মোটর গ্যারেজে শিশুটির পায়ুপথে বাতাস ঢুকানোর পর তার মৃত্যু হয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বড় ভাইয়ের সঙ্গে গ্যারেজে এসেছিল শিশুটি। গ্যারেজের মালিক পাউরুটি–চা আনার ফরমায়েশ দিলে শিশুটিকে রেখে বড় ভাই দোকানে যায়। ফিরে এসে দেখে ভাইয়ের পেট ফুলে আছে। সারা গায়ে বমি। পায়ুপথ দিয়ে রক্ত পড়ছে। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ঘটেছে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাদ এলাকার একটি মোটর গ্যারেজে। পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে সংঘবদ্ধভাবে শিশু হত্যার অভিযোগে বুধবার পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সালে খুলনায় রাকিব (১২) এবং ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ইয়ামিন (১৩) নামের দুই কিশোরের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। ওই দুই কিশোর কারখানায় কাজ করত।
আজ সরেজমিন ঘটনাস্থল মোটর গ্যারেজ, শিশুটির মায়ের বাসা ও পল্লবী থানায় গিয়ে জানা যায়, নিহত শিশু আবু বক্কর সিদ্দিক জাবেদ আলী ও মোছা. আয়শার দুই সন্তানের মধ্যে ছোট। সে ফুলকলি–৭ নামের একটি এনজিও স্কুলে শিশু শ্রেণিতে পড়ত। বাবা বাসচালক ও মা পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। মনোমালিন্য থাকায় শিশুটির মা–বাবা বাউনিয়াবাদে আলাদা বসবাস করেন। শিশু দুটি মায়ের সঙ্গে থাকত। প্রায় এক বছর আগে ‘আলহামদুলিল্লাহ বাইক সার্ভিস সেন্টার’ নামে একটি গ্যারেজে কাজে ঢোকে আবুর বড় ভাই মো. জিহাদ (১২)।
পায়ুপথে বাতাস প্রবেশ করানোর কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পল্লবী থানা–পুলিশ। এ ঘটনায় একজন অজ্ঞাতনামাসহ চারজনের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় ওই হত্যা মামলা করেছেন শিশুটির মা আয়শা। আসামিদের একজন কিশোর হওয়ায় শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, তার নাম উল্লেখ করা হলো না। বাকি দুই আসামি রাজু (২০) ও মো. সুজন খান (৩৬)।
![]() |
রাজধানীর পল্লবী থানার সিঁড়িতে বসে কাঁদছেন শিশুটির মা আয়শা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আবু বক্করের মা–বাবা ও পরিবারের সদস্যরা জানান, জিহাদ তাঁদের জানিয়েছে, বেলা তিনটার দিকে সে আবুকে নিয়ে গ্যারেজে যায়। গ্যারেজ মালিকদের একজন মো. সুজন খান তাকে পাউরুটি–চা এনে দিতে বললে সে ভাইকে রেখে দোকানে যায়। ফিরে এসে দেখে আবু বমি করছে, পেট ফুলে আছে। পাশে অভিযুক্ত কিশোর দাঁড়ানো। কী হয়েছে, জানতে চাইলে ওই কিশোর তাকে জানায়, মোটরসাইকেল পরিষ্কার করার পাম্প দিয়ে সে আবুর পায়ে বাতাস দিয়েছে। তাতে আবু বমি করছে। এ কথা শুনে বিশ্বাস না হওয়ায় জিহাদ আবুর প্যান্ট খুলে দেখে মলদ্বার দিয়ে রক্ত পড়ছে। রক্ত কেন পড়ছে, জানতে চাইলে ওই কিশোর তাকে বলে, পায়ে বাতাস দেওয়ায় আবুর পেট ফুলে গেছে, পরে সে মুখের ভেতর পাম্প করে বাতাস দিয়ে পেটের বাতাস বের করার চেষ্টা করেছে। একপর্যায়ে বমি করতে করতে আবু অচেতন হয়ে পড়লে সুজনসহ কয়েকজন আবুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ছোটে। পরিবারের দাবি, ওই কিশোর, হৃদয় নামের আরেক তরুণ, রাজু, সুজন সবাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা শিশু আবুকে একা পেয়ে মজার ছলে হত্যা করেছে। মামলার এজাহার থেকে হৃদয়ের নাম কেন বাদ পড়ল, সেই প্রশ্ন তাঁদের।
আজ বেলা একটায় বাউনিয়াবাদে পোড়া বস্তি পেরিয়ে ডি ব্লকে ‘আলহামদুলিল্লাহ বাইক সার্ভিস সেন্টার’এ গিয়ে দেখা যায়, গ্যারেজটি তালাবন্ধ। গ্যারেজের সাইনবোর্ডে মালিক হিসেবে মো. রাতুল ও মো. সুজন খান— দুজনের নাম লেখা। গ্যারেজের সামনে লোকজনের জটলা। সেখানে বসে ছেলের জন্য বিলাপ করে কাঁদছিলেন বাবা জাবেদ আলী। তিনি বলেন, বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটে। তিনি তখন বাসায় ছিলেন। গ্যারেজের দুই মালিকের একজন সুজনসহ কয়েকজন তাঁর ছেলেকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেছে শুনে সেখানে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে শোনেন তাঁর ছেলেকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়েছে। শিশু হাসপাতাল থেকে বলা হয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ওই হাসপাতালে পৌঁছে তিনি দেখেন, বড় ছেলে জিহাদের কোলে আবু নিথর পড়ে রয়েছে। চিকিৎসক তাঁর ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেছেন। জিহাদ পড়াশোনায় ভালো নয় বলে কাজ শেখার জন্য গ্যারেজে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।
![]() |
রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাদ এলাকার মোটর গ্যারেজটির পাশে বসে কাঁদছেন শিশুটির বাবা জাবেদ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শিশুটির মা আয়শার সঙ্গে কথা বলার জন্য এ ব্লকের ১২ নম্বর লাইনের ১২ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি বাসায় নেই। পল্লবী থানায় গেছেন। পল্লবী থানায় আবুর মা আয়শা, বড় ভাই জিহাদ, নানি চন্দ্র বানুসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে পাওয়া যায়। মা আয়শা বড় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। আয়শা বলেন, তিনি অনেক কষ্টে সন্তানদের নিয়ে চলেন। যারা তার ছেলেকে এভাবে হত্যা করেছে, তিনি তাদের বিচার চান।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ময়নাতদন্তের পর আবুর লাশ থানায় আসবে। তাঁরা লাশ নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে পায়ুপথে বাতাস ঢোকানোর কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। একজন কিশোরকে আটক করা হয়েছে। কিশোর হওয়ায় তাকে সমাজসেবা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। পুলিশ তদন্ত করে বোঝার চেষ্টা করছে, কে কী উদ্দেশ্যে শিশুটির পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়েছিল। গ্যারেজে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। অন্য এক দোকানের সিসিটিভির ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।
পুলিশের কাছ থেকে নেওয়া সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, একজনের কোলে অচেতন আবু। সঙ্গে কয়েকজন। আবুকে কোলে নিয়ে তাঁরা রিকশায় উঠছেন।
এদিকে গ্যারেজ মালিক মো. রাতুল ও মো. সুজন খানের মুঠোফোন নম্বরে কল করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।
বেসরকারি সংগঠন ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স বাউনিয়াবাদ এলাকায় শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে। শিশু আবু সংগঠনটির সেবা কার্যক্রমের আওতায় ছিল। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, শিশুটিকে একা পেয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। শিশুদের সুরক্ষায় রাষ্ট্র ও সমাজের কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।