প্রতিনিধি সীতাকুণ্ড
পদত্যাগপত্রে জোর করে সই নেওয়া হয় তোবারক আলী চৌধুরী (টিএসি) উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যের(মাঝে সাদা শার্ট) কাছ থেকে। বুধবার দুপুরে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর হাজী তোবারক আলী চৌধুরী (টিএসি) উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার দুপুরে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন এই শিক্ষক। পরে একটি গাড়িতে করে তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং প্রক্তন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয়ে মিছিল নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষককে ঘেরাও করে রাখেন। পরে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেন বলে অভিযোগ।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের পরিচালনায় গঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতির পদ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় বিএনপির নেতা–কর্মীরা। কমিটির বর্তমান সভাপতি জামায়াত সমর্থিত মহিউদ্দিন আহমেদ। এ কারণে এ ঘটনায় জামায়াত সমর্থক ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়। বিদ্যালয়ের অ্যাডহক কমিটির বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিনের এক আত্মীয়ের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সোহেল রানা বলেন, ভাটিয়ারী টিএসি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার খবরে তিনি ঘটনাস্থলে যান। বিদ্যালয় এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।
জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেওয়া পদত্যাগপত্রটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পদত্যাগপত্রে লেখা হয়েছে, ‘আমি আমার ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম।’ এই একটি বাক্য ছাড়া পদত্যাগপত্রে আর কোনো কিছু লেখা ছিল না।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আশ্চর্য বলেন, আজ বেলা ১১টার দিকে বিদ্যালয়ের ভেতরে তাঁর নিজ কার্যালয়ে তিনি ও অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছিলেন। এ সময় মিছিল নিয়ে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। এরপর আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা তাঁকে জিম্মি করে রাখেন। পরে নুরুল আবছার নামের একজন নিজের হাতে পদত্যাগপত্র লেখেন। ওই পদত্যাগপত্রে আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা জোর করে তাঁর স্বাক্ষর নেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার বিদ্যালয়ের নবগঠিত অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন জামায়াত সমর্থিত মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর পুনর্মিলনী পরিষদের সদস্যসচিব ছিলেন। অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অনুমোদন দেয় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড।
প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য বলেন, সভাপতি নির্বাচনের জন্য চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে যোগ্যতাসম্পন্ন তিনজনের নাম পাঠাতে হয়। তিনি তিনজন ব্যক্তির নাম প্রথমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে পাঠান। এরপর ইউএনও সেটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে এই তালিকা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো হয়। এরপর শিক্ষা বোর্ড মহিউদ্দিনকে অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে অনুমোদন দেয়।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পুনর্মিলনী কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন করার জন্য এসেছিলেন। মূলত প্রধান শিক্ষক তিনটি নাম প্রস্তাব করার পর চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে তাঁরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। তিনি বিষয়টি ইউএনও এবং পুলিশকে অবহিত করেন। পরে তিনি সীতাকুণ্ড থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি জামায়াতের রাজনীতি করেন। এখানে রাজনৈতিক কোনো বিষয় ছিল না। আন্দোলনকারী ব্যক্তিরা এসে তাঁকে খুব গালমন্দ করেন। বিদ্যালয়ের ভেতরে ঝামেলা হচ্ছে শুনে তাঁর আত্মীয়স্বজনও আসেন। এ সময়ে আন্দোলনকারীদের হামলায় তাঁর ভগ্নিপতি মো. ফারুকের মাথা ফেটে যায়। তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে ভাটিয়ারী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নুরুল আনোয়ার বলেন, কান্তি লাল আচার্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করে মিছিল–সমাবেশ করেন। উত্তেজিত জনতার চাপে প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানোর বিষয়টি তিনি জেনেছেন। কোনো শিক্ষককে পদত্যাগ না করাতে সরকারের বেশ কয়েকটি পরিপত্র রয়েছে। এ বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।