প্রতিনিধি ময়মনসিংহ
![]() |
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাবা–ছেলেকে হত্যার পর যাত্রাশিল্পী হারুন অর রশিদের বাসা ভাঙচুর করা হয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় চুরির অপবাদে ডাকা সালিসে না যাওয়ায় বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় পুরো এলাকা এখনো থমথমে। পুরো ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। বাবা-ছেলেকে হত্যার পর মানুষকে উসকে পাশের ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও তাঁর ভাইয়ের বাড়িসহ পাঁচটি বাড়ি এবং একটি মাজারে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় এখনো আতঙ্ক আছে।
গত রোববার দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও ইউনিয়নের নাওগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামে আবদুল গফুর ও তাঁর ১৫ বছর বয়সী কিশোর ছেলে মেহেদী হাসানকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে গফুরের চাচাতো ভাই নাওগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান জড়িত বলে নিহত দুজনের পরিবারের অভিযোগ। বাবা-ছেলেকে হত্যার ঘটনায় শিল্পী আক্তার বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। শিল্পী আক্তার নিহত গফুরের দ্বিতীয় স্ত্রী।
গত রোববার রাতেই থানায় মামলা হয়। মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হলেও মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কেউ গ্রেপ্তার হননি।
হামলায় হাবিবুর রহমান ছাড়াও চুরির অপবাদে ডাকা সালিসে নেতৃত্ব দেওয়া স্থানীয় ইউপি সদস্য শামছুল হক ওরফে সাম্পে মেম্বার ও রাঙ্গামাটিয়া ইউপির সদস্য সিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরু মেম্বারও আসামি হয়েছেন। তাঁরা সালিসে উপস্থিত থেকে হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ। ঘটনার পর থেকে তাঁরা সবাই এলাকাছাড়া।
![]() |
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়ার আবদুস সালামের বাড়ি ভাঙচুর করা হয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সরেজমিন গফুরের বাড়ি
গতকাল নাওগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামের নিহত আবদুল গফুরের বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী, সন্তান ও ছোট বোনকে পাওয়া যায়। এ সময় ছোট বোন রোকসানা বেগম বলতে থাকেন, ‘এক পোয় চাউল যে জাল কইরা খাইবো, এমন কিচ্ছু থই নাই। আমার ভাইরে ও তাঁর পোলারে মারছে, লগে সবকিছু শেষ কইরা দিছে। ভাইরে মারছে—এই খবর পাইয়া বাড়িত আইয়া দেহি ঘরের মুখে পইড়া রইছে। আমারে দেইখ্যা খালি পানি খাইতে চাইছে। কিন্তু আমারে পানি দিতে দেই নাই। আমার চাচাতো ভাইয়েরা লোকজন নিয়ে মারছে আমার ভাইরে। আমাদের বড় জেঠার ছেলে হাবিবুর হুকুম দিয়ে মারাইছে, নিজেও মারছে।’
আবদুল গফুর পৈতৃক সূত্রে বেশ জমির মালিক। তাঁর বাড়িটি একতলা। বাড়ির চারদিকে টিনের সীমানা থাকলেও সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির ভবনের দুটি কক্ষের মধ্যে একটিতে দুটি খাট ও পাশের একটি কক্ষে নিজের জিম করার নানা জিনিসপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে, ভাঙচুর করা। ঘরের দরজা-জানালা ভাঙা। বাড়ির এক কোণে পড়ে আছে খাটিয়া। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যায় বাড়িতে লাশ নেওয়ার পর রাত ৮টার দিকে জানাজা হয়। পরে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার গোরস্তানে দাফন করা হয়। গফুরের ঘরে পড়ে ছিল বাঁশের লাঠি। এই ঘরেই বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
দুটি মরদেহ গোসল করান গফুরের ভগ্নিপতি আবু সামাহ। তিনি বলেন, তিনি তাঁর জীবনে এমন নৃশংস মৃত্যু দেখেননি। গফুরের কারণে তাঁর গোষ্ঠীর ও আশপাশের বড় বড় লোক মাতবরি করতে পারত না। তাঁকে মেরে ফেললে মাতবরির সুযোগ পাওয়া যাবে, সে কারণে মেরে ফেলছে।
আবদুল গফুরের প্রথম স্ত্রী মিনা আক্তারের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় সম্রাস হাসান ও মেহেদী হাসান নামের দুই সন্তানকে রেখে। মেহেদীর যখন দেড় বছর বয়স, তখন বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। মেহেদী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়লেও আর পড়ালেখা না করে বেপরোয়া জীবন যাপন করত। মাদকে আসক্ত হয়ে পড়লে প্রায় বছরখানেক আগে ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় বাবা আবদুল গফুর। পরে মাদক মামলায় জেল খেটে গত দেড় মাস আগে বাড়িতে আসেন মেহেদী। গত ১৯ মার্চ রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় এক বাড়িতে চুরি করতে গেছে—এমন অভিযোগে মেহেদীকে আটকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করেন সেখানকার লোকজন। সেই ভিডিও ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে।
![]() |
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় বাবা-ছেলেকে হত্যার ঘটনাস্থল পরির্দশন করে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দ্বিতীয় সংসারে আবদুল গফুরের তিন মেয়ে। বাবার জন্য কাঁদছে মেয়েরা। গফুরের দ্বিতীয় স্ত্রী মামলার বাদী শিল্পী আক্তার বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখেই আমার স্বামী বলতে থাকে, তুমি আমার তিনটা সন্তান নিয়ে পলাও। সন্তান নিয়ে তুমি বাইচ্চা থাক।’ তাঁর অভিযোগ, জমি নিয়ে চাচাতো ভাসুরদের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ছিল। তাঁরাই তাঁর স্বামীকে হত্যা করেছে। তিনি স্বামী হত্যার বিচার চান।
নিহত আবদুল গফুরের মামা মিন্টু সরকার বলেন, তাঁর ভাগনে আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। তাঁর কোনো পদ ছিল না। এলাকায় যত সালিস হতো, সব তাঁর ভাগনে করত। তাঁর (গফুর) চাচাতো ভাই ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মাতব্বরি করতে পারত না। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল। সে কারণে ও জমি নিয়ে বিরোধে তাঁর ভাগনেকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
আবদুল গফুরের বড় ভাই আবুল কালাম বলেন, তাঁদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে মুঠোফোন ও কিছু কাগজ চুরি করলে ফরহাদ নামের একজন ধরা পড়ে। এ জন্য সালিস ডাকা হয়েছিল, সেখানে তাঁর ছোট ভাই ও ভাতিজাকেও ডাকা হয়। কিন্তু না যাওয়ায় তাঁর চাচাতো ভাই বাড়িতে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভেঙে তাঁর ভাই ও ভাতিজাকে মেরে ফেলেছে। চাচাতো ভাইয়ের জমি গফুর বন্ধক নিয়েছিল। সেই জমি থেকে আরও কিছু টাকা চাইলে মূলত বিরোধ বাড়ে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফুলবাড়িয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. লিটন মিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, পারিবারিক পূর্ববিরোধ ও ছেলে মেহেদীকে চুরির অপবাদ দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বাকিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। হত্যার কিছু আলামত জব্দ করা হয়েছে।
‘মাদকের আখড়া’ আখ্যা দিয়ে মাজার ও বাড়িতে ভাঙচুর-আগুন
বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার পর পাশের রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান সিরাজের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে ভাঙচুর, স্থানীয় বনকর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ আরও দুটি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। এসব বাড়িতে মাদকের আড্ডা হয়, কেনাবেচা হয় ও সেবন করা হয়; এসব অভিযোগ তুলে আক্রমণ করে একদল লোক।
নাওগাঁও ইউনিয়ন ও রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন পাশাপাশি। নাওগাঁও পশ্চিমপাড়া গ্রামে আবদুল গফুর ও তাঁর ছেলে মেহেদী হাসানকে হত্যা ও বাড়িঘর ভাঙচুরের পর ২০০-৩০০ লোক জড়ো হয়ে রাঙ্গামাটিয়া বাজারে হামলা করে হারুন অর রশিদের বাসায়। তিনি রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান সিরাজের ছোট ভাই। হারুন যাত্রামঞ্চে অভিনয় ও গানবাজনা করেন। মাদক গ্রহণ ও আবদুল গফুরের সঙ্গে ওঠাবসা আছে—এমন অভিযোগ এনে তাঁর বাসায় হামলা করে তছনছ করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের।
![]() |
একটি পীরের মাজার ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন হারুনের স্ত্রী চম্পা আক্তার। তিনি বলেন, হামলায় তাঁর সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে।
রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট গ্রামে শাহজাহান সিরাজের বাড়ির পাশে নূরাই পীরের দরগাহে হামলা করে সেটি ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মাজারে দাঁড়িয়ে কথা হয় আবদুল বাসেদ শেখ নামের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবা-ছেলেকে হত্যার পর সেটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে মাজার ও অন্যান্য বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান সিরাজের স্ত্রী নূর জাহান বেগম বলেন, ‘আমরা এত খারাপ হলে আমার স্বামী তিনবার চেয়ারম্যান হতো না। আমাদের বাড়ি কেন ভাঙতে আসে, তা বুঝতে পারিনি।’
হাতিলেইট গ্রামের বনের ভেতর বন বিভাগের জমিতে বসবাস করেন গোলাপ হোসেন তরফদার। তিনি বন বিভাগে প্রহরী হিসেবে চুক্তিভিক্তিক কাজ করেন। তাঁর বাড়ির দুটি ঘর কুপিয়ে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম আহাজারি করে তাঁর বাড়িতে তাণ্ডব চালানোর বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ২৫ বছরের সাজানো সংসার শেষ কইরা দিছে। আমার স্বামী যদি গাজা-মদের ব্যবসা করতো, তাইলে কি আমরার বনের মধ্যে থাকতে অইতো?’
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকনুজ্জামান বলেন, কেন এগুলোতে হামলা হলো, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। মাদকের আখড়া আখ্যা দিয়ে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সীমান্ত এলাকা নয় যে মাদকের ভরপুর থাকবে। টুকটাক মাদক সেবন করে, বিচ্ছিন্ন এমন হতে পারে।’ জোড়া হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এমনটি করা হয়েছে কি না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এমন হতে পারে, আমরা তদন্ত করে দেখছি।’