নিজস্ব প্রতিবেদক
![]() |
প্রতীকী ছবি |
পরিবার পরিকল্পনার অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর চরম সংকট দেখা দিয়েছে দেশে। চাহিদার তুলনায় সরকারি সরবরাহ নেমে এসেছে এক-চতুর্থাংশে। জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের গত এক বছরের পরিসংখ্যানে এই চিত্র উঠে এসেছে। কোনো কোনো অঞ্চলে সরবরাহ শূন্যের কোঠায়। এতে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ এবং কম বয়সে বিবাহিত মেয়েদের গর্ভধারণের আশঙ্কা বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞেরা এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশের মানুষের ব্যবহৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি অর্থাৎ ৩৭ শতাংশ আসে সরকারি খাত থেকে। এ ছাড়া বেসরকারি খাত থেকে ৫৭ শতাংশ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো (এনজিও) থেকে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসে ৪ শতাংশ উপকরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি খাত প্রধান উৎস না হলেও মোট জনসংখ্যার বিশাল আকারের বিবেচনায় ৩৭ শতাংশকে বড় হারই বলতে হবে।
মোট সাত ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে পাঁচ ধরনের পদ্ধতি সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে—খাওয়ার বড়ি, ইনজেক্টেবল, কনডম, ইমপ্ল্যান্ট ও আইইউডি।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ব্যবহৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে খাওয়ার বড়ি ৪৯ শতাংশ, ইনজেক্টেবল ১৯ শতাংশ, কনডম ১০ শতাংশ, ইমপ্ল্যান্ট ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, আইইউডি ৩ শতাংশ এবং পুরুষের এনএসভি অস্ত্রোপচার এবং নারীর টিউবেকটমি অস্ত্রোপচার (স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ) ১২ শতাংশ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সরকারিভাবে সাধারণত মাসে ৬০ থেকে ৭০ লাখ পাতা (প্রতি পাতায় ২৮ বড়ি) খাওয়ার বড়ি বিতরণ করা হয়। স্বাভাবিক সময়ে অন্যান্য সামগ্রী বিতরণের সংখ্যা হচ্ছে ইনজেক্টেবল ৭ থেকে ১০ লাখ, কনডম ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি, ইমপ্ল্যান্ট ৩০ থেকে ৬০ হাজার এবং আইইউডি ১০ থেকে ১৪ হাজার। তবে সরকারিভাবে সামগ্রীগুলোর সরবরাহ নিশ্চিত না করতে পারায় গত এক বছর এসবের বিতরণ কমে এসেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার কমতে শুরু করেছে। তখন খাবার বড়ি সরবরাহ করা হয়েছিল ৬১ লাখ। আর সর্বশেষ গত মাসে তা মাত্র ২ লাখে নেমে এসেছে। একইভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৯ লাখ ইনজেক্টেবলের ব্যবহার হলেও গত মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজারে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ২৩ লাখ কনডম ব্যবহার হয়েছে। এটি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম। গত মাসে কনডমের ব্যবহার ঠেকেছে ৬ লাখ ৮০ হাজারে। গত মাসে ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার হয়েছে পৌনে ২ হাজার। আর আইইউডির ব্যবহার হয়েছে ১ হাজারেরও কম।
অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ৪৯৪টি উপজেলার মধ্যে খাওয়ার বড়ি নেই ১৫১টি উপজেলায়। ১৩১টিতে শিগগির মজুত শূন্য হবে। ৭৬টিতে চাহিদার তুলনায় কম রয়েছে। একইভাবে ১০৬টি উপজেলায় কনডম এবং ১৩৩টি উপজেলায় আইইউডির মজুত নেই। অন্যান্য পদ্ধতির উপকরণগুলোর মজুতের ক্ষেত্রেও একই ধরনের চিত্র দেখা গিয়েছে।
অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, গত বছরের শুরুতে উপকরণ কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তবে তৎকালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ সচিব মো. আজিজুর রহমান ক্রয়ের অনুমোদন দেননি। তিনি যেসব উপকরণ আছে, তা দিয়ে কাজ ‘চালিয়ে নিতে’ বলেছিলেন। উচ্চপদস্থ এ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, তৎকালীন ওই সচিবের ‘দূরদৃষ্টির অভাবে’ এখন সারা দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া গত জুনে স্বাস্থ্য খাতের কৌশলগত পরিকল্পনা (ওপি) শেষ হয়েছে। ৫ বছর মেয়াদি নতুন ওপি না হওয়ায় স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
এক জেলার চিত্র
মাদারীপুর জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মতিউর রহমান বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে খাবার বড়ি মাঠে নেই। কনডম আছে। ইনজেক্টেবল, আইইউডি আছে। ইমপ্ল্যান্ট সামনের মাসে শেষ হবে। আমরা দম্পতিদের বিকল্প পদ্ধতির পরামর্শ দিচ্ছি। যেমন—নারীদের প্রয়োজনে নিজ উদ্যোগে বড়ি কিনে খেতে বলছি। অথবা আমাদের কাছে বিকল্প যে পদ্ধতি রয়েছে তা গ্রহণ করার কথা বলি। ফলে সংকট যে গুরুতর আকার ধারণ করেছে, তা বলা ঠিক হবে না।’
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা
দেশে বর্তমানে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ১ বলে জানিয়েছে বিবিএস। একজন নারী তার প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর) গড়ে যতটি সন্তানের জন্ম দেন, তা-ই মোট প্রজনন হার। অর্থাৎ দেশে বর্তমানে একজন নারী গড়ে দুটির বেশি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের সংকটের কারণে দেশে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ, কিশোরী গর্ভধারণ ও গর্ভপাতের হার বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সরকার যেসব উপকরণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই পান অসচ্ছল প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা। ঘাটতির কারণে তাঁরা উপকরণ হাতে পাচ্ছেন না। ফলে অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ বাড়বে।
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে গুরুত্ব কমিয়েছে। তাদের অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রতিক দশকে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী মহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাকে কার্যত উপেক্ষা করা হয়েছে।
বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এখন বাংলাদেশ। এহেন দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাফল্যের আপাত স্থবিরতার চিত্র উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেনের পর্যবেক্ষণে। আলাপকালে তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের স্বর্ণযুগ ছিল গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশক। ১৯৯৩ সালে আমাদের মোট প্রজনন হার ছিল ৩ দশমিক ৩। তখন থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত হার একই রকম ছিল। ২০০৪ এবং ২০০৭ সালে এসে তা কিছুটা কমে। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হার একই অবস্থায় রয়ে গেছে।...আর গত কয়েক বছর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতিগত ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিষয়টিকে ইদানীং সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।’
ড. মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন আরও বলেন, দেশের ৭৪ শতাংশ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে সক্ষম। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছে বা উপকরণ পাচ্ছে ৬৪ শতাংশ দম্পতি। যে দশ শতাংশের সন্তান জন্মদানের পরিকল্পনা নেই, তাদের হাতে কোনো উপকরণও নেই। ওইসব নারীর অনেকে অপ্রত্যাশিতভাবে সন্তান ধারণ করছেন বা গর্ভপাত করাচ্ছেন। এর মধ্যে উপকরণ সরবরাহে সংকট হলে স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
উপকরণ সরবরাহের চলমান সংকট নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আশরাফী আহমদ বলেন, ‘ওপি হঠাৎ করে বন্ধ হওয়ায় ক্রয়প্রক্রিয়া থেমে গিয়েছিল। আমরা রাজস্ব বাজেট থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণগুলো কেনার চেষ্টা করছি। ক্রয়ের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে।’