নিজস্ব প্রতিবেদক

পণ্য পরিবহন হয়েছে ট্রাকযোগে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিভিন্ন বন্দর এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে | গ্রাফিকস: পদ্মা ট্রিবিউন 

গত ১৫ মাসে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ৩৬টি দেশে প্রায় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এতে আয় হয়েছে প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু সম্প্রতি ভারত হঠাৎ করে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করায় রফতানি কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

২০২০ সালের জুনে ভারত বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয়। এর আওতায় পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল-পেট্রাপোল হয়ে পশ্চিমবঙ্গের দমদম বিমানবন্দর বা কলকাতার সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে যেত। এই ব্যবস্থায় সময় ও খরচ উভয়ই সাশ্রয় হতো। কিন্তু ৯ এপ্রিল ভারতের কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর ও শুল্ক বোর্ড (সিবিআইসি) আকস্মিকভাবে এই সুবিধা বাতিল করে।

সিবিআইসির এই আদেশের পরদিনই বেনাপোল সীমান্তে আটকে যায় তৈরি পোশাক খাতের তিন প্রতিষ্ঠানের চারটি ট্রাক। স্পেনে রফতানির জন্য পাঠানো এসব পণ্য পেট্রাপোল কাস্টমস থেকে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ফেরত নিতে হয়।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা ব্যবহার করে বাংলাদেশ প্রায় ৩৪ হাজার ৯০৯ মেট্রিক টন তৈরি পোশাক রফতানি করেছে, যার মূল্য প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন ডলার।

২০১৮ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এই সুবিধা ব্যবহারে এখন পর্যন্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান ৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, যার মধ্যে ৬০৬টি প্রতিষ্ঠান ছিল পোশাক খাতভুক্ত।

এখন পুরো রফতানি কার্যক্রম এসে পড়ছে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে। বেসরকারি হিসাবে, অতিরিক্ত ৪৪ হাজার টনের পণ্য পরিবহনের জন্য বছরে প্রায় ৭৩০টি অতিরিক্ত ফ্লাইট দরকার হবে। এতে ইউরোপ ও আমেরিকার রুটে খরচ এবং সময়—দুটোই বাড়বে।

কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহারে প্রতি কেজি পণ্যে ৫০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত কম খরচ হতো বলে জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। এছাড়া ঢাকার বুকিং জটও এড়ানো যেত।

বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, 'ভারত একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা হতাশাজনক। এই পথটি খরচ সাশ্রয়ী এবং কার্যকর ছিল। এখন তা বন্ধ হওয়ায় রফতানিতে দেরি এবং ব্যয় বাড়বে।'

সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, 'বিকল্প রুট হিসেবে আমরা মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার বৃদ্ধির চিন্তা করছি।'

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এ ধরনের হঠাৎ সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদের বিকল্প অবকাঠামো এবং রুটে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।'

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানও কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করার ওপর জোর দেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, 'আমরা আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে দ্রুত এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠবো। যেসব বাধা রয়েছে, তা কাঠামোগত ও খরচজনিত। এগুলো সমন্বয় করে সক্ষমতা বাড়ানো হবে।'

সরকারিভাবে ভারতের সঙ্গে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়নি বলে জানান তিনি।

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি হচ্ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, চিলি, চীন, কলম্বিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, নেপাল, ফিলিপাইনস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ আফ্রিকা—সহ ৩৬টি দেশে।

রফতানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল নারীদের ব্লাউজ, প্যান্টি, স্কার্ট, পুরুষদের কোট, ট্রাউজার, শিশুদের পোশাক, ট্র্যাকস্যুটসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়। এসব পোশাক তৈরি হয়েছিল কটন, সিনথেটিক টেক্সটাইল ও স্যানিটারি ফাইবার দিয়ে।

ট্রান্সশিপমেন্ট হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একটি দেশের পণ্য অন্য দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পাঠানো হয়। এই পদ্ধতিতে পণ্য দ্রুত এবং তুলনামূলক কম খরচে পৌঁছানো যায়। ফলে বাংলাদেশি পোশাক বিশ্ববাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছিল।

তবে ভারত হঠাৎ করে সেই সুবিধা বন্ধ করায় এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাত।