কূটনৈতিক প্রতিবেদক ঢাকা

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক | ছবি: প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজ

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন টানাপোড়েনের কেন্দ্রে রয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার ব্যাংককে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আলোচনায়ও এসেছে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ।

অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বৈঠকে তুলেছে ঢাকা। পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন, তিস্তা চুক্তি সইসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত উদ্বেগ জানিয়েছে। দিল্লি আশা প্রকাশ করেছে, ভবিষ্যতে ভারত এমন এক গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে নির্বাচনের একটি ভূমিকা রয়েছে।

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের সাংরিলা হোটেলে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৪০ মিনিটের বৈঠকে দুই নেতা সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছেন। আলোচনায় পারস্পরিক স্বার্থ ও উদ্বেগের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে।

বৈঠকের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলা হয়েছে, বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে বাংলাদেশের গভীরভাবে মূল্য দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমাদের দুই দেশের জনগণের কল্যাণের স্বার্থে সম্পর্ককে সঠিক পথে স্থাপনের লক্ষ্যে আপনার সঙ্গে একত্রে কাজ করতে চাই।’

বৈঠকের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজের এক্স হ্যান্ডলারেও লিখেছেন। তাতে বলা হয়, ‘ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি গঠনমূলক ও জনগণকেন্দ্রিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। আমি বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছি। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিয়ে আমাদের গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।’

শেখ হাসিনাকে ফেরতের প্রসঙ্গ

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ব্যাংককে সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিয়ে কথা হয়েছে। আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা (প্রত্যর্পণ), ভারতে বসে তিনি যেসব উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, সে প্রসঙ্গেও কথা হয়েছে।

বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টেও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির কাছে জানতে চান। এ বিষয় এখন ভারত সরকারের কাছে বিবেচনাধীন রয়েছে। 

অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উসকানিমূলক মন্তব্য করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন, যা ভারতের তার প্রতি আতিথেয়তার অপব্যবহার বলে মনে হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা ও উসকানিমূলক অভিযোগ করে আসছেন। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা ভারত সরকারকে অনুরোধ করছি যে তিনি আপনার দেশে থাকাকালীন এই ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’

ব্যাংককের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস অনুরোধ করেছেন কি না, জানতে চাইলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শেখ হাসিনার যে বিষয়টি আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে অনুরোধ এসেছে, সেই বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল। আমাদের যে মুখপাত্র, তিনি এই বিষয়ে আপনাদের অবগত করেছেন। আমাদের কাছে এই বিষয়ে একটি অনুরোধ এসেছিল। তা নিয়ে আর কিছু বলা আমার এখন সমীচীন হবে না।’

প্রসঙ্গ: সংখ্যালঘু নির্যাতন

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সদস্যদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দুই নেতার বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের গভীর উদ্বেগ তিনি (নরেন্দ্র মোদি) ব্যক্ত করেছেন। বাকি সমাজে এর যে প্রভাব, তা নিয়ে তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের যে দায়িত্ব, সেটা তারা পালন করবে বলে তিনি আশা করেন।’

প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির উদ্বেগের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা অনেকটাই অতিরঞ্জিত এবং ‘এর বেশির ভাগই ভুয়া খবর’। তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে সাংবাদিক পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন, যাতে তাঁরা কথিত হামলার ঘটনা অনুসন্ধান করতে পারেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তিনি দেশে ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার প্রতিটি ঘটনা নজরদারির আওতায় আনতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা চালু করেছেন এবং তাঁর সরকার এমন যেকোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দুষলেন মোদি

বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক খারাপ হয়, এমন বক্তব্য পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে।

বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (মোদি) আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, পরিবেশ খারাপ করে, এমন বক্তব্য এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।’

শেখ হাসিনার মন্তব্য ঘিরে উত্তেজনার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের সংযুক্তি একটি দেশের সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নয়। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে জনগণের।’ 

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ভারত

অধ্যাপক ইউনূসের বৈশ্বিক মর্যাদার কথা স্মরণ করেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জনগণকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা বয়ে এনেছে। তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার নিরিখে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।

বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিক্রম মিশ্রি বলেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিষয়েও অধ্যাপক ইউনূসকে অবগত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভবিষ্যতে ভারত একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়। এই ব্যাপারে নির্বাচনের একটি ভূমিকা আছে, তা সবাই জানেন।

উল্লেখ্য, ভারত সাংবিধানিক বৈধতার কথা বলে ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালে ‘ডামি’ প্রার্থীর নির্বাচনে বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিল। এই নির্বাচনগুলোর পর ক্ষমতায় যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন ছিল নয়াদিল্লির।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে জোর ইউনূসের

অধ্যাপক ইউনূস সীমান্ত হত্যার বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে একসঙ্গে কাজ করলে কেবল অনেক পরিবারই বড় ধরনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না, বরং আস্থা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সাহায্য করবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সব সময় কষ্ট অনুভব করেন। ভারতকে এই ঘটনাগুলো প্রতিরোধের জন্য উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শুধু আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায় এবং মৃত্যুর ঘটনাগুলো ভারতের ভেতরেই ঘটে। উভয় নেতা বিষয়টি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রিসহ অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।