সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম

রমনা পার্কের শিশুচত্বরের দোলনায় ছোট্ট আরশী খন্দকার। দোল দিচ্ছেন বাবা রবিউল ইসলাম। সামনে সন্তানের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে মা সামিয়া ইয়াসমিন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

রাজধানীর রমনা পার্ক। পার্কের শিশুচত্বরের স্লিপার বেয়ে নামতে চেষ্টা করছিল ছোট্ট এক মেয়েশিশু। পরনে আকাশি রঙের জামা। ভারসাম্য ঠিক রাখতে স্লিপারের দুপাশ থেকে সন্তানের দুই হাত ধরে রেখেছিলেন মা ও বাবা। শিশুটির নাম আরশী খন্দকার।

বৃহস্পতিবার আরশীর জন্মদিন। তিন বছর পূর্ণ হয়েছে তার। জন্মদিনে ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছে, ‘আজ তো একটু রমনা পার্কেও যেতে পারতাম।’ জন্মদিনে একমাত্র সন্তানের আবদার মেটাতে তাই পার্কের শিশুচত্বরে ছুটে এসেছেন মা–বাবা।

মা সামিয়া ইয়াসমিন আরশীকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বললেন, তাঁর এই ছোট্ট মেয়েকে সপ্তাহে অন্তত একদিন রমনা পার্ক বা অন্য কোনো খোলা জায়গায় নিয়ে যেতে হয়। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা খন্দকার রবিউল ইসলাম। তিনি এগিয়ে এসে জানালেন, তাঁর সন্তানটি গাছ ভালোবাসে। বাসার ছাদের গাছে পানি দেয় সে।

জন্মদিনে সন্তান আরশীকে নিয়ে মা–বাবা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত রবিউল ইসলাম বললেন, মেয়ের জন্য বাসায় পাখি রাখতে হয়। সে অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছকে খাবার খাওয়ায়। আর বেড়াতে যেতে ইচ্ছা হলেই তাকে নিয়ে উন্মুক্ত কোথাও যেতে হয়। সেখানে সে খেলতেও পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা সচেতনভাবে ওকে প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হতে দিতে চাই না। চেষ্টা করি যেন প্রকৃতির প্রতি টান জন্মায়।’

আরশীর জন্ম খুলনায়। তখন রবিউল ইসলাম ছিলেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। আরশী দেড় বছর বয়স পর্যন্ত জেলা শহরে কাটিয়েছে। সেখানে গাছপালা দেখেছে সে। ২০২৩ সালের শেষ দিকে বাবা রবিউল ইসলাম মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে ঢাকায় এলে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে পড়ে সে। তাই হাঁসফাঁস করে বাইরে খেলতে যাওয়ার জন্য।

আরশী বসে আছে দোলনায়। দোল দিচ্ছেন বাবা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

তবে এই শহরে শিশুদের খেলার জন্য কোনো জায়গা নেই বলে অভিযোগ করলেন আরশীর মা–বাবা। এমনকি বড়রাও কোথাও নিরাপদ নয় বলে অভিযোগ করলেন মা সামিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটা কত সংবেদনশীল দেখুন, নিজের জন্মদিনে এতটুকু শিশু গাছপালার কাছে আসতে চায়। কিন্তু এ জায়গাটা (রমনা পার্ক) সব সময় নিরাপদ না। মাঝেমাঝে কিছু অল্পবয়স্ক ছেলেরা এখানে ওদের পোষা কুকুর দিয়ে ভয় দেখায়।’

এই মা তাঁর সন্তানকে প্রকৃতির কাছে নিতে মাঝেমধ্যে রমনা পার্কে একাই নিয়ে আসেন। কখনো কখনো কোনো ঘটনায় ভয়ও পেয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এই মা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘পার্কের শিশুচত্বরের খেলনাগুলো দেখুন। যাদের ওঠার কথা না, তারা দোলনায় উঠে ওটা নষ্ট করে রেখেছে। এটা ভাঙা, ওটা নষ্ট। আসলে এই শহরে বচ্চাদের জন্য উন্মুক্ত কোনো জায়গাই নেই, যেখানে খেলার সুযোগ আছে। ইনডোর গেম আর আউটডোর গেম এক না।’

রমনা পার্কের শিশুচত্বরে খেলায় মত্ত একটি শিশু | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

সামিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘মেয়েকে নিয়ে এখানে আসি কারণ, অনেক রকম গাছ আছে। পাখি ডাকে, কাঠবিড়ালি দৌড়ায়। আমার বাচ্চা এগুলো দেখতে পছন্দ করে। ওর বাবা সকালে অফিসে চলে গেলে মাঝেমধ্যে মেয়েকে নিয়ে পার্কে হাঁটি। এখান থেকেই ওর অভ্যাস হয়েছে গাছপালা ভালোবাসার।’

জীবনের চতুর্থ বছর শুরু করা আরশী তখন মায়ের কোলে বসে বুঝতে চেষ্টা করছে, ওর সম্পর্কে ভালো কথা বলা হচ্ছে কি না। ওর বাবা তখন ধরে রেখেছেন মেয়ের গোলাপি ব্যাগটা। শিশুচত্বরের পাশেই ফুটেছে অঞ্জনগাছের বেগুনি ফুল। রমনা পার্কের উদ্ভিদ বিভাগের ওভারশিয়ার মোহাম্মদ সোহাগ উদ্দিন জানালেন, রমনায় থাকা বিরল প্রজাতির গুটিকয় গাছের মধ্যে এই অঞ্জনগাছ একটি।