প্রতিনিধি সীতাকুণ্ড

টিসিবি | প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুই মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রায় সাত হাজার স্মার্ট কার্ড। কার্ড ইস্যু হওয়ার পরও বিতরণ না করায় টিসিবির পণ্য কিনতে পারছেন না এসব ভোক্তা। স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের সুপারিশের কারণে এসব কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছে। দল দুটির নেতারা জানিয়েছেন, আগের তালিকায় আওয়ামী লীগের লোকজনের প্রাধান্য থাকায় নতুন তালিকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা।

বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল বশর বলেন, তিনি মক্তবে শিশুদের পড়িয়ে সংসার চালান। গত সোমবার তিনি টিসিবির পণ্য কিনতে গিয়েছিলেন। তবে টিসিবির কার্ড না থাকায় পণ্য পাননি। অথচ বিএনপি-জামায়াত নেতাদের স্লিপ নিয়ে যাঁরা গেছেন, তাঁদের কার্ড না থাকা সত্ত্বেও পণ্য দেওয়া হয়েছে। তিনি শুনেছেন তাঁর নামে স্মার্ট কার্ড ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) রয়েছে। তবে খোঁজ নিতে গেলে ইউপি কার্যালয় থেকে জানানো হয় তাঁর কার্ড এখনো হয়নি।

এলাকার আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তিনি পুরোনো কার্ড নিয়ে পণ্যের জন্য দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য পাননি। তিনি স্মার্ট কার্ডের জন্য ছবি তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কার্ড হয়েছে কি না, তিনি জানেন না।

ওই ইউনিয়নে ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন পাশের কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শোভন ভৌমিক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নে মোট ১ হাজার ৬৫ জনের স্মার্ট কার্ড এসেছে। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৫২৯টি স্মার্ট কার্ড। যাঁরা স্মার্ট কার্ড পেয়েছেন, তাঁদের কাছে পণ্য বিক্রি করার পরও কিছু পণ্য রয়ে যায়। সেগুলো ফেরত না পাঠিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে হতদরিদ্র মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়।

উপজেলা প্রশাসন জানায়, স্মার্ট কার্ডধারীরা সচ্ছল কি না, পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যোগ্য ব্যক্তিদের কার্ড বিতরণ চলমান রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের কাছে উপকারভোগীদের বিতরণের জন্য ১০ হাজার ৪৭২টি স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে দেড় মাসে ৩ হাজার ৫৫০টি কার্ড বিতরণের পর অ্যাকটিভ (চালু) করা হয়েছে। যা মোট উপকারভোগীর ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। বাকি ৬ হাজার ৯৯২টি স্মার্ট কার্ড চালু হয়নি।

ভাটিয়ারী ইউনিয়নে উপকারভোগী রয়েছে ১ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে কার্ড এসেছে ১ হাজার ৮২ জনের। তবে ৫২০টি কার্ড বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবুল বশর। কুমিরা ইউনিয়ন পরিষদে স্মার্ট কার্ডের আওতায় এসেছে ১ হাজার ৩৭৫ জন। কার্ড বিতরণ হয়েছে ৪৬৫টি। সলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আল আমিন বলেন, উপকারভোগী ১ হাজার ৬২৬ জনের মধ্যে কার্ড এসেছে ৯২৫টি। এখন পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে ৪৫০টি কার্ড। তাঁর এলাকার অনেক উপকারভোগী ভাসমান। অনেকে মুঠোফোন ব্যবহার করেন না। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিরা এলাকায় না থাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়েও কার্ডগুলো বিতরণ করা যাচ্ছে না।

তবে একাধিক ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কার্ডগুলো দুই মাস আগে এলেও বিতরণ কাজ স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম। বর্তমান ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম যোগদানের পর টিসিবির কার্ডগুলো বিতরণের নির্দেশ দেন। কিন্তু বিতরণ শুরুর আগে জামায়াত ও বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিক তালিকা দেওয়া হয়। কার্ড বিতরণের খবরে ওই দুই দলের নেতারা একাধিক দফায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করে ৩০ শতাংশ কার্ড বিতরণ করে বাকিটা তাঁদের তালিকা থেকে দেওয়ার জন্য চাপ দেন। শেষ পর্যন্ত ইউএনও ৫০ শতাংশ স্মার্ট কার্ড বিতরণের নির্দেশ দিয়েছেন।

জানতে চাইলে উপজেলা জামায়াতের আমির মো. মিজানুর রহমান বলেন, টিসিবির উপকারভোগীদের বিষয়ে তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে পরিমাণ স্মার্ট কার্ড এসেছে, তার ৩০ শতাংশ বিতরণ করা হবে। বাকি ৭০ শতাংশ উপকারভোগীর নতুন তালিকা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জমা দেওয়া হবে। এ তালিকা করার জন্য জামায়াতের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগের তালিকায় কেবল আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রাধান্য ছিল। এখন আর তা থাকবে না।

উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব কাজী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, আগের সরকার গরিবদের কথা চিন্তা করেনি। দলের নেতা-কর্মীদের কার্ড দিয়েছে। এখন যাঁরা হকদার, তাঁরা কার্ড পাবেন। তাই নতুন তালিকা করতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে ইউএনও মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, টিসিবির লোকজন প্রতিটি ইউনিয়নে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বিক্রির জন্য নিয়ে যান। স্মার্ট কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করার পর নিম্ন আয়ের মানুষ যাঁরা তাৎক্ষণিক জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে উপস্থিত হন, তাঁদের কাছে অবশিষ্ট পণ্য বিক্রি করা হয়। এখানে কোনো দলের নেতা-কর্মীদের টোকেন কোনো বিষয় নয়। সম্প্রতি তিনি যোগদানের পর টিসিবির কার্ড বিতরণ করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু অভিযোগ আসছে যাঁরা টিসিবির কার্ড পাওয়ার যোগ্য নন, তাঁদেরও কার্ডের আওতায় আনা হয়েছে। পরে তিনি কার্ডগুলো যাচাই-বাছাই করে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেন। যোগ্য লোকদের কার্ড বিতরণের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ‘আগের তালিকাটা যাচাই-বাছাই করেছেন আগের ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। ওই তালিকা ঢাকা পাঠানো হয়েছে বলেই তো স্মার্ট কার্ড ইস্যু হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কীভাবে বাছাই করেছিল সেটা আমার জানা নেই।’