সালমান তারেক শাকিল

মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হলে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য রোহিঙ্গাদের ঢল নামে | ফাইল ছবি

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে নতুন কিছু পরিকল্পনার বিষয়ে আভাস পাওয়ায় নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।

গত ২০ দিনে সঙ্গে আলাপকালে বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে, সেই আগ্রহটিকেই মূল সন্দেহ হিসেবে বিবেচনা করছেন নেতারা। বিশেষ করে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রগুলোর তৎপরতায় অনেকটা ‘কপালে চোখ উঠেছে’ রাজনীতিকদের।

বিভিন্ন দলের সর্বোচ্চ নেতারা বলছেন, নির্বাচন ইস্যু পেছনে ফেলতে সংস্কার ইস্যুটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে সরকারের ভেতরে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে প্রভাবশালী দেশি-বিদেশি পক্ষ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের ঐক্যবদ্ধ তৎপরতাকে আমলে নিচ্ছেন নেতারা।

আলাপকালে একাধিক দলের প্রধান জানান, এপ্রিল নাগাদ রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে আসছে বড়সড়ভাবে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকে সামনে রেখে এই ইস্যুটি আরও বিবেচনায় আসছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ মার্চ চীন সফরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এই সফরে বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। মূলত চীনের ব্যাপক আগ্রহে প্রফেসর ইউনূসের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরের দিকে মনোযোগী রাজনীতিকরা।

রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রেখে ঈদ মৌসুমের পর রাজনীতিতে বিরোধিতার সূত্রপাত তৈরি হতে পারে। এমনকি রাজনীতিতে সম্মুখ বিরোধিতার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়নি একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র।

ইতোমধ্যে গত ১৭ মার্চ গোপন বৈঠকের সময় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে পৃথক অভিযানে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ বা আরসা) ১০ সদস্যকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে বিষয়টি আরও চাউর হয়েছে।

একটি দলের প্রধান বলেন, ‘দেশের প্রাণকেন্দ্রে বসে আরসার নেতারা যেভাবে বৈঠক থেকে গ্রেফতার হয়েছেন, এটি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। পাশাপাশি বিষয়টি সন্দেহজনকও।’

প্রফেসর ইউনূসের চীন সফরের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সফর করছেন মার্কিন সিনেটর গ্যারি পিটার্স। তার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ১১৮তম কংগ্রেসে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং গভর্নমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান এবং সিনেট অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন কমিটি, সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটি এবং সিনেট কমার্স, সায়েন্স এবং ট্রান্সপোর্টেশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন গ্যারি।

ঢাকা সফরে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, মূল কমিশনগুলোর প্রতিবেদন এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করার কথা জানানো হলেও আদতে গ্যারির সফরের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে সতর্ক রয়েছেন রাজনীতিকরা।

সিনেটর গ্যারি পিটার্সের পর ২৪-২৫ মার্চ ঢাকা ঘুরে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্যাসিফিক কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডিং জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জোয়েল পি ভাওয়েল। তার সফরে স্পষ্টভাবেই সমরাস্ত্র বিক্রির প্রসঙ্গটি ছিল মুখ্য।

একাধিক দলীয় প্রধান মনে করছেন, সরকারের প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের প্রাক্কালে মার্কিন দায়িত্বশীলদের বাংলাদেশ সফর ও মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যকে বৈশ্বিক রাজনীতির কূটকৌশলের অংশ হিসেবেই দেখছেন তারা।

নেতাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা কোনও পরিকল্পনা আদৌ কার্যকর হবে কিনা, এই প্রশ্ন রয়ে যায়।

২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বেসরকারি নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির আয়োজনে ‘রিস্টোরিং পিস ইন মিয়ানমার: টু ইয়ারস আফটার মিলিটারি ক্যু’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পাসকৃত যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’-এর কারণে দেশটির নানা অঞ্চলে সংঘর্ষ আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং এই অবস্থায় কোনও পক্ষে শামিল না হওয়া বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক।

ওই সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি সেমিনারে বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ইস্টার্ন অ্যাপ্রোচ (চীনের নীতি) অনুসরণ করছে, যা ব্যর্থ হয়েছে। এখন আমাদের পশ্চিমা নীতি (বার্মা অ্যাক্ট) অনুসরণ করা প্রয়োজন।’

শুক্রবার এ বিষয়ে জানতে চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে কল করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেসের ‘আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা তাদের নিজভূমে থাকবে’- এমন আশাবাদের পর ইস্যুটি নিয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন দেশের রাজনীতিকরা।

বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের ঠেলে পাঠানো হলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। উপরন্তু চীনকে পাশ কাটিয়ে এই ইস্যুতে সমাধান আশা করা কতখানি রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হতে পারে—তা নিয়ে সতর্ক রয়েছেন রাজনীতিকরা।

রাজনীতিকদের সন্দেহ, মূলত রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে সামনে রেখে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে হেলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যে কারণে আগামী নির্বাচনের সময়ে এর প্রভাব পড়তে পারে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ইঙ্গিত রেখেছেন, তা নিয়েও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রশ্ন তুলেছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘বিএনপি সামগ্রিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার সফরের সাফল্য কামনা করছে। আমরা তো ভালো দেখতে চাই। বিএনপি সব সময় দেশ ও মাটির পক্ষে ছিল। দেশের জন্য উনি (প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস) যেন ভালো কিছু করতে পারেন, সেই আশা করছি।’

এক্ষেত্রে বিএনপি কি রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান চাইছে নাকি দেশে আর্থিক বিনিয়োগে চীনকে পাশে চায়—এ প্রসঙ্গে সেলিমা রহমানের ভাষ্য, বিএনপি দেশের সামগ্রিকভাবে ভালো চায়। বিএনপি দেশের বড় রাজনৈতিক দল। সব সময় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিএনপির কাছে বড়।

বিএনপির একটি প্রভাবশালী সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রকে আমলে রেখে চীনের কাছ থেকে রোহিঙ্গা সমাধানের দিকে অন্তর্বর্তী সরকার ঝুঁকলে—তাতে সমাধান আসতে পারে। সরকার-প্রধানের চীন সফরটি এই ইস্যুটিকেই কেন্দ্র করে, এমনটি মনে করে এই সূত্র।