প্রতিনিধি রাজশাহী
রাজশাহীতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় | ছবি: সংগৃহীত |
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালককে (ইডি) বের করে দিয়ে চেয়ার দখলের ঘটনায় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার পর আরও দুই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান স্বাক্ষরিত পৃথক অফিস আদেশে তাঁদের বরখাস্ত করা হয়।
এ ছাড়া সংস্থাটির চেয়ারম্যান এম আছাদুজ্জামানের কাছে ঘটনার ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ঘটনা তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
সাময়িক বরখাস্ত দুই কর্মকর্তা হলেন নির্বাহী প্রকৌশলী সেলিম রেজা ও সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। তাঁদের মধ্যে সেলিম রেজা বিএমডিএর সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের দায়িত্বে আছেন। আর আবুল কালাম আজাদ বিএমডিএর রাজশাহী কার্যালয়ে কর্মরত।
বিএমডিএ সূত্রে জানা গেছে, বরখাস্ত হওয়া সেলিম রেজা সিরাজগঞ্জে কর্মরত। তিনি কোনো অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থল থেকে রাজশাহীতে চলে এসেছিলেন। অতিরিক্ত সচিবকে হেনস্তার সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এ জন্য তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে শুক্রবার বিএমডিএ চেয়ারম্যান এম আছাদুজ্জামানকে ফোন করলেও তিনি ধরেননি। তবে বিএমডিএর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গতকাল চেয়ারম্যানকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে ওই ঘটনার জন্য ভর্ৎসনা করা হয়। পাশাপাশি সংস্থার প্রধান হিসেবে এ বিষয়ে তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
বিএমডিএর ইডি শফিকুল ইসলামকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু রিলিজ অর্ডার না পাওয়ায় তিনি দপ্তর ছাড়তে পারছিলেন না। এর মধ্যে ২৩ মার্চ দুপুরে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে ইডির দপ্তরে ঢুকে পড়েন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান। তাঁরা তাঁকে জোরপূর্বক দপ্তর ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরে অফিস আদেশ ছাড়াই ইডির চেয়ারে বসে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম খান।
ঘটনার পরপরই কৃষি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম এবং ২৫ মার্চ রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মন্ত্রণালয়ের রিলিজ স্লিপ না পাওয়ায় বিএমডিএ থেকে তিনি অবমুক্ত হতে পারছিলেন না। রিলিজ স্লিপ না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে বিএমডিএতে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানের নেতৃত্বে তাঁর অনুসারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে বিএমডিএ ছেড়ে যেতে চাপাচাপি করছিলেন। তিনি তাঁদের রিলিজ স্লিপ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা কোনো কথা শোনেননি। এমনকি অফিস ত্যাগ করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ৩০ মিনিট সময় চাইলেও তা দেওয়া হয়নি। এ সময় জোর করে তাঁর থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয় বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মেহেদী, সহকারী মেকানিক মো. আপেল, মেহেদী হাসান, গুদামরক্ষক মো. নুরুজ্জামান, মজিবুর রহমান, আব্দুল কাইয়ুম খান, ক্যাশিয়ার শফিকুল ইসলাম, গাড়িচালক মো. শাহাবুল, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শমসের আলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। এতে অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁরা আত্মগোপন করেছেন। অফিসও ছুটি হয়ে গেছে। এ জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনা তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমামকে আহ্বায়ক ও উপসচিব মো. মনিরুজ্জামানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। অন্য চার সদস্যের মধ্যে আছেন বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম ও মো. জাফরুল্লাহ। কমিটিতে জেলার একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে রাখতে বলা হয়েছে।
ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ ও বিএমডিএ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সুপারিশসহ কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএমডিএর ইডির পদটি প্রশাসন ক্যাডারের একজন অতিরিক্ত সচিবের জন্য সংরক্ষিত পদ। মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রেষণে এ পদে নিয়োগ দেয়। অতিরিক্ত সচিব শফিকুল ইসলাম জুলাইয়ে এ পদে নিয়োগ পেয়ে বিএমডিএতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁকে হেনস্তা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মেনে নিতে পারেননি।
বিএমডিএ পরিচালনা বোর্ডের সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালকের পদটি একটি প্রশাসনিক পদ, যা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রিত। কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে অপরাধী হলে তাঁর বিষয়ে তদন্ত হতে পারে। শফিকুল ইসলামের বদলির পর মন্ত্রণালয় তাঁকে রিলিজ করা সত্ত্বেও যদি তিনি তাঁর বর্তমান স্থানে না গিয়ে পূর্ববর্তী স্থানে জোরপূর্বক অবস্থান করেন, তাহলে মন্ত্রণালয় বিষয়টি বিবেচনা করবে। কিন্তু তাঁকে চেয়ার থেকে টেনে নামানো এবং সেই চেয়ার দখল করা চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন। দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, যা দরকার ছিল। তদন্তের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলম খানের অন্য সহযোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তাঁরা আশা করছেন।