নিজস্ব প্রতিবেদক
![]() |
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে শুক্রবার সকাল থেকে সতর্ক অবস্থান নেয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী। বিভিন্ন পরিবহনে তল্লাশিও চালানো হয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক বক্তব্য। তিনি বলেছেন, 'সরকারের কোনো পরিকল্পনাই নেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। তবে যেসব নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচার চলবে এবং তাঁরা আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন।' তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মহলের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, যা নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কৌশলী অবস্থান নিয়েছে। তাঁরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বরং তাঁদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, কোনো বিশেষ কারণে তাঁরা সরকারকে রুষ্ট করতে চাইছে না।
উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান কৌশলে বলেছেন, তাঁরা দেশে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চান না।
অন্যদিকে, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, 'আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে এবং এই মাফিয়াগোষ্ঠীর রাজনীতিতে ফেরার যেকোনো প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করা হবে।'
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো আপস নেই।'
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, 'লড়াইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্য আমরা প্রস্তুত।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একদিকে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিলেও দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। পশ্চিমা প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলো কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। ওই দেশগুলোর এই অবস্থান বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ।
কারণ, এই দুই দলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করে, তাই বিদেশি কূটনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা করে তাঁদের চলতে হয়। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনেও কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) প্রেসিডেন্ট ড. কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, 'সরকারের কোনো পরিকল্পনাই নেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার। তবে যেসব নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের বিচার চলবে এবং তাঁরা আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবেন।'
তিনি আরও জানান, 'জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত সম্ভাব্য অপরাধের জন্য আওয়ামী লীগের কিছু নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। তবে এটি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।'
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর জাতীয় নাগরিক পার্টি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানীর সড়কগুলোতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, 'দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছে। আমাকে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে ফেরানোর জন্য ‘আসন ভাগের’ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।' নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনার বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি এবং দাবি করেন, 'এই পরিকল্পনা ভারতের ইন্ধনে হচ্ছে।'
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছেন, 'তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।'
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, 'যাঁরা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত এবং বিভিন্ন সময়ে বিগত ফ্যাসিবাদের সময়ে জনগণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন পলাতক অবস্থায় আছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'গণহত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তাঁরা পলাতক বা কারাগারে রয়েছেন।'
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'যাঁরা আওয়ামী লীগ করেছেন, কিন্তু কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁরা ক্ষমা চেয়ে আবার মূল ধারায় (মেইনস্ট্রিম) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেন। তবে কেউ যদি সাজাপ্রাপ্ত হন বা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে তাঁরা কোনোভাবেই নির্বাচনে আসতে পারবেন না।'
সংস্কারের কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হোক—এটি চায় না বিএনপি। দলটি যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করে আসছে। অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদ নির্বাচন চায়। এদিকে, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ চূড়ান্ত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কিছু রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক বক্তব্য আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি কৌশল হতে পারে। সরকারের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করার জন্য নেওয়া হয়েছে। তাঁরা চায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করেও রাজনৈতিক মেরুকরণ বজায় রাখতে। তবে, সরকার যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে, তাহলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। এখন দেখার বিষয়, সরকার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল কীভাবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে এবং এর ফলে দেশে স্থিতিশীলতা নাকি সংঘাত তৈরি হয়।