নিজস্ব প্রতিবেদক
শুক্রবার রাতে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সেনাবাহিনী বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ এনেছেন, তা রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বোমা ফাটিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদও। তার দাবি, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হোক, ‘তা চাননি’ সেনাপ্রধান।
তাদের এমন বক্তব্যের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়; সড়কে সেনাবাহিনীর অবস্থান দেখা গেছে অন্য দিনের তুলনায় বেশি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে একটি ঝটিকা মিছিল করেছে ‘ছাত্রলীগ’।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরাসরি কোনো অবস্থান প্রকাশ না করে বিএনপি বলছে, ক্ষমতাচ্যুত দলটির রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ‘জনগণ’।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ ‘মেনে নেবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান।
তিনি বলেছেন, 'জনগণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গণহত্যার বিচারটাই দেখতে চায়। এর বাইরে অন্য কিছু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সর্বস্তরের জনগণকে সংযত, সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থেকে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানাই।'
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দলের নেতা হাসনাতের বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে প্রস্তাব বা হস্তক্ষেপের এখতিয়ার সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। এ ধরনের চর্চা যাতে বাংলাদেশে আর না হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের মত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম চালানোর অধিকারের বিষয়টি ‘জনগণের রায়ের’ ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আইন করে বা চাপিয়ে দিয়ে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা ‘ভালো বার্তা বহন করে না’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, 'কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নই। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, মানুষের কাছে কোন দল রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকবে কিনা সেটা মানুষ তার গণতান্ত্রিক মতামতের যে প্রক্রিয়া, সেটি সুষ্ঠুভাবে হলে জানান দিতে পারে, কোন দলকে সে চায়, কোন দলকে চায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করতে হয়। আইন করে বা চাপিয়ে দিয়ে সেটা করাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো বার্তা বহন করে না।'
হাসনাতের বক্তব্যের বিষয়ে জোবাইদা নাসরীন বলেন, 'ফেইসবুক পোস্ট নিয়ে মন্তব্য দেওয়া কঠিন। গতকাল ও আজকের- দুদিনের রাজনৈতিক প্রবাহ অনেক বেশি ভিন্নতা ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্ট বক্তব্য ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা মিছিল হয়েছে গণমাধ্যমে জেনেছি।'
তবে বিষয়টি নিয়ে সেনা সদর কিংবা আইএসপিআরের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন হঠাৎ কেন আলোচনায়
তবে দলটির যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের আদালতে বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন তিনি।
তার ওই বক্তব্যের পর রাতে ফেইসবুক পোস্টে সেনানিবাস থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে ‘চাপ দেওয়ার’ অভিযোগ তোলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
![]() |
২০২৪ সালের ৮ অগাস্ট দেশে ফিরে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন মুহাম্মদ ইউনূস। বিমানবন্দরে তাকে বরণ করে নেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা | ফাইল ছবি |
ওই বৈঠকে ‘৪০ বছরের বেশি সময়’ সেনাবাহিনীতে কর্মরত একজন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের মতবিরোধ ও বচসা হওয়ার কথা তুলে ধরে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, এক পর্যায়ে বৈঠক শেষ না করেই তাদের চলে আসতে হয়েছে।
হাসনাত তার পোস্টে লিখেছেন, 'আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়–ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে–তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনি দেখবেন গত দুইদিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছে।'
ইউনূসের বক্তব্য এবং হাসনাতের ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে শুক্রবার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে।
শুক্রবারও একই দাবিতে পৃথক বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ মঞ্চ’ নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্মের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
এক মাসের বেশি সময় ধরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
ওই আন্দোলনের মধ্যে ১৪ শ মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে। সেসব ঘটনায় হামলার জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তার সরকারের মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হচ্ছে।
জুলাইয়ের সেসব নিহতের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অপরদিকে আন্দোলন দমনে ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগকে অনেকে এখন ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন। সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারাও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে।
এরইমধ্যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও দলটির নিবন্ধন বাতিল চেয়ে গত ১৯ অগাস্ট হাই কোর্টে রিট আবেদন হয়েছে এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে। অবশ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ওই রিট আবেদন থেকে সরে আসেন হাসনাতরা।
এদিকে, রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে শুক্রবার রাতে একটি ঝটিকা মিছিল বের করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একদল নেতাকর্মী। মিছিল থেকে তিনজনকে আটকের কথা বলেছে পুলিশ।
কী বলেছেন আসিফ মাহমুদ
হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে উত্তাপের মধ্যে এক ভিডিওবার্তায় অভ্যুত্থানের আরেক ছাত্রনেতা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ অভিযোগ করেছেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হন, ‘তা চাননি’ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু ছাত্রনেতাদের অনড় অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত মেনে নেন।
৬ অগাস্ট বঙ্গভবনে ওই বৈঠকের ঘটনাক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, 'সেনাপ্রধানের দিক থেকে মূল ভেটোটা (আপত্তি) ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন? হোয়াই নট এনি আদার পারসন (অন্য কেউ কেন নয়)? ড. ইউনূসের নামে মামলা আছে। তিনি একজন কনভিকটেড পারসন (দণ্ডিত ব্যক্তি)। একজন কনভিকটেড পারসন কীভাবে আসলে একটা দেশের প্রধান উপদেষ্টা হতে পারে?'
উনি সরাসরি বলেছেন যে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারটাকেতো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, আওয়ামী লীগতো ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দুচক্ষে দেখতে পারে না, একদম অপছন্দ করে। তো, আওয়ামী লীগ একটা লোককে একেবারে দেখতে পারছে না, বাংলাদেশেতো আলটিমেটলি ৩০-৪০ শতাংশ মানুষতো আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করে। এই ৩০-৪০ শতাংশ মানুষের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা লোককে প্রধান উপদেষ্টা করা উচিত’?'
আসিফ মাহমুদ বলেন, 'সেনাপ্রধান লাস্ট, আমার মনে পড়ে আমাদের বলেছিলেন, ‘আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে এই সিদ্ধান্তটা মেনে নিচ্ছি'।’
কী লিখেছেন হাসনাত
সেনানিবাস থেকে আসা প্রস্তাবের বিষয়ে হাসনাত তার পোস্টে লিখেছেন, 'আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়–ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে–তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে।একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনি দেখবেন গত দুইদিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছে।'
![]() |
হাসনাত আব্দুল্লাহ | ছবি : ফেসবুক |
হাসনাত লিখেছেন, 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমাদেরকে আরো বলা হয়–রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।'
সেনা কর্মকর্তাদের এমন প্রস্তাবের বিরোধিতার কারণে বৈঠকে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের বচসা হয় বলে ফেইসবুকে পোস্টে দাবি করেছেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তিনি লিখেছেন, 'আমাদেরকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন। এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরনের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং ‘আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক। আলোচনার এক পর্যায় বলি–যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, ‘ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডম অ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর অ্যাটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া ইনক্লুসিভ ইলেকশন হবে না। উত্তরে বলি, আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে ফেরাতে হবে। আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা করা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে। পরে- মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়।'
এরপর শুক্রবার রাতে এনসিপির ডাকা জরুরি সংবাদ সম্মেলনেও ফেইসবুক পোস্টে লেখা ঘটনার একটি বর্ণনা দেন হাসনাত আব্দুল্লাহ।
নতুন দলের এই মুখ্য সংগঠক বলেন, 'গত ৫ অগাস্টের পর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন সময় দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু ১১ মার্চের সাক্ষাতের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। আমাদেরকে সেখানে আহ্বান জানান হয়েছিল। অপর প্রান্তে ঊর্ধ্বতন ও কর্মকর্তারা ছিলেন।'
সেনা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে তা ফেইসবুকেই ‘স্পষ্ট করা হয়েছে’ মন্তব্য করে হাসনাত বলেন, 'এটা রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বলে আমরা মনে করছি। রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ রাজনীতিবিদদের হাতে থাকা উচিত।'
তিনি বলেন, 'কিছুদিন আগে সেনাপ্রধানের একটা বক্তব্য আপনার লক্ষ্য করেছেন। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এটাকে অশোভন হিসেবে ধরা হয়েছে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে যেভাবে অ্যাড্রেস করা হয়েছে, আওয়ামী লীগসহ ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে।'
এই ঘটনার পর নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করছেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে হাসনাত বলেন, 'ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যতক্ষণ ঐক্যবদ্ধ, ততক্ষণ নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি অনুভব করছি না। আওয়ামী লীগ যে একটা গণহত্যা চালাইছে, সে এটাই স্বীকার করে নাই। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বোধ নেই। সেজন্য আমরা বলছি আগে তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে, দল হিসেবে বিচার নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধ স্বীকার করতে হবে, তারপর অন্য কোনো আলোচনা হইলে হইতে পারে। এর আগে আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ধরনের আলোচনা অসম্ভব, ইম্পসিবল,' বলেন হাসনাত।
রাজনীতিক ও বিশ্লেষকদের ভাষ্য
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে পারবে কিনা, তা চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে চালানো হত্যাযজ্ঞের বিচারের পরে নির্ধারণ হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, 'অনেক কথা উঠছে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না। যারা গণহত্যা চালালো তাদের বিচার হবে কিনা? কারা চালিয়েছে এটা কি মানুষ দেখেনি? কোন পুলিশ, কোন ওসি, কোন এসপি, কোন ডিসি এখানে ভূমিকা রেখেছে। কার নির্দেশে কার বলায় এই গণআন্দোলনে রক্ত ঘটানোর জন্য, এই গণআন্দোলন ধ্বংস করার জন্য, দমন করার জন্য কার নির্দেশ, আওয়ামী লীগের কোন নেতাদের নির্দেশ রয়েছে। আপনারা (সরকার) এদের বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে পারলে…আওয়ামী লীগ পুরনো দল, এখন সেই দলের যারা অপরাধী, অপরাধের বিচার হলে তারপরে তারা জনগণের কাছে গিয়ে, জনগণ যদি তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয় সেখানে তো আমাদের কিছু বলার নেই।'
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম শুক্রবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে আবারো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলে ধরেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শুক্রবার রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার, জনগণ ও বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় কোন প্রতিষ্ঠানের এই বিষয়ে কোন মন্তব্য বা পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। এই ধরনের চর্চা যাতে বাংলাদেশে না হয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিকভাবেই হবে এবং সামনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই আমরা উত্তরণ করতে চাচ্ছি।'
সংবাদ সম্মেলনে এনসপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, 'আজ থেকে সাত মাস আগে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছিল। আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। বিদেশি শক্তিগুলো অনেক সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে এসব দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় নাগরিক পার্টি শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করছে।'
ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে পদত্যাগ করে রাজনীতিতে নামা এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, বলেন, 'গণ-অভ্যুত্থানের সাত মাস অতিবাহিত হলেও ‘গণহত্যাকারী’ শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের খুনিদের বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আমরা তার বক্তব্যের নিন্দা জানাই। আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, গুম-ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।'
অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের বিষয়টি গত ৭ অগাস্ট জানান সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান | ফাইল ছবি |
তিনি বলেন, 'এনসিপি মনে করে, বিচারিক কার্যক্রমের পরিণতি দৃশ্যমান হতে হবে। কৃত অপরাধের বিচার, দায় স্বীকার, অনুশোচনা, পাপমোচন ব্যতীত আওয়ামী লীগের দল হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার পক্ষে যে কোনো ধরনের তৎপরতা ‘ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের শামিল’। এনসিপি জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ফ্যাসিবাদী রেজিমে সংঘটিত অপরাপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নিশ্চয়তা চায়। বিচার চলাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে এবং এই মাফিয়াগোষ্ঠীর রাজনীতিতে ফেরার যেকোনো প্রচেষ্টাকে এনসিপি প্রতিহত করবে।'
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক দল কেন নিষিদ্ধ থাকবে–সেই প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ বলেন, 'আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল নয়; বরং এটি একটি ফ্যাসিবাদী দল। নানা অপরাধের বিচার অনিষ্পন্ন রেখে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার যে কোনো ধরনের আলোচনা ও প্রস্তাব এনসিপি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে।'
কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে ‘না থাকার’ কথা তুলে ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, 'আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। এর আগে নিপীড়নের বিষয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে। এর চেয়ে বড় নিপীড়নের অভিযোগ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে আছে, সেটাও দাবি মধ্যে আছে। আসলে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নই।'
দেশে কোনো দল দেশে টিকে থাকবে কি, থাকবে না তা বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মতামতের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে বলে মন্তব্য করেন এ অধ্যাপক। 'আইন করে বা চাপিয়ে দিয়ে সেটা করাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভালো বার্তা বহন করে না। রাজনৈতিক দলের ভিত্তি থাকে, জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ, কতটা আস্থা বহন করছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি জনগণের কাছে আস্থাভাজন না হয়, জনগণ যদি তাদেরকে বাতিল করে দেয়-সেটিই হবে গুরুত্বপূর্ণ।'
তার ভাষায়, 'একটি রাজনৈতিক দল কতটুকু জনবান্ধব, জনমুখী সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।'
![]() |
শুক্রবার থেকে ঢাকার রাস্তায় বেড়েছে সেনাবাহিনীর তল্লাশি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বেড়েছে তল্লাশি
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলার মধ্যে ছাত্রলীগ ছেড়ে আসা সাবেক ছাত্রনেতা হাসনাতের দাবির বিষয়ে সেনা সদর কিংবা আইএসপিআরের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দেশজুড়ে যৌথ বাহিনীর চলমান অভিযানের মধ্যেই ঢাকায় সেনা সদস্যদের তৎপরতা বেড়েছে।
শুক্রবার সকাল থেকে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে বাড়তি টহলের পাশাপাশি তল্লাশি চৌকি বসিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী অবশ্য বলছেন, 'এই তৎপরতা সেনা সদস্যদের ‘নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। এটি সেনা সদস্যদের পার্ট অব ডিউটি, বাড়তি টহল বা চেকপোস্ট বলে কিছু নেই। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সেনা সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।'
শুক্রবার দিনের বিভিন্ন সময় রামপুরা, শান্তিনগর, কাকরাইল, জাতীয় প্রেসক্লাব, বায়তুল মোকাররম, মহাখালী, বিজয় সরণি, গুলশান, খিলক্ষেত এলাকায় চৌকি বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে সেনা সদস্যদের।
যৌথ বাহিনীর অভিযানের আওতায় পরিচালিত এসব চৌকিতে সন্দেহভাজন মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার থামিয়ে তল্লাশি চালাতে দেখা গেছে।