নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা
![]() |
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
‘প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের খবর শুনি আর আঁতকে উঠি। শিশু থেকে বৃদ্ধা কেউই ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ২০১৯ থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি ফুলটাইম চাকরি করছি। চাকরির সুবাদে এমনও হয়েছে রাত ২টায় অফিস শেষে স্কুটি চালিয়ে বাসায় এসেছি। তবে আগে এত অনিরাপদবোধ করিনি। আর এখন শুধু রাতে না দিনেও নিজেকে অনিরাপদ লাগে।’
এভাবেই নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়ুয়া শিক্ষার্থী জেনিসিয়া বর্ণা। নারী দিবস নিয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অসংখ্য নারী শিক্ষার্থী সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার রেশ টেনে তাদের অনিরাপত্তার কথা জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার নারীদের জীবনে আঁধার নেমে এলেও ধর্ষকেরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। কঠোর কোনও বিচার দেখতে পাই না। কেউ একবারও ভাবে না, ধর্ষণের শিকার নারী কখনও এই ট্রমার মধ্যে থেকে বের হতে পারবে কিনা! দিন শেষে ঘুরেফিরে সব দোষ যেন নারীদের। এসব দেখে নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা মন থেকে হারিয়ে যায়। নারী হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি এটাই অনেক মনে হয়। তবুও বারবার নিজের ভেতর আশার জন্ম দেই, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা নারীরা নিরাপদে রাস্তায় হাঁটতে পারবো, নিঃশ্বাস নেবো। বাস, সিএনজি, মোট্রো, রিকশা কোথাও আমাদের হয়রানি করা হবে না। কোথাও কোনও ধর্ষণ হবে না।’
নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তাজফিহা উখরোজ বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর জীবনে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা যেন এক অনিবার্য বাস্তবতা। ৩ বছরের শিশুকন্যা থেকে শুরু করে ৩০ বছরের যুবতী—কেউ-ই নিরাপদ নয়। গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, এই সমাজ নারীদের জন্য কতটা অনিরাপদ। গৃহস্থালির কাজ থেকে কর্মক্ষেত্র— সব জায়গায় নারীরা শোষণের শিকার। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে যে, অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাওয়ার ফলে সমাজে অপরাধের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।’
নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন উল্লেখ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে কেবল আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়; দরকার কঠোর বাস্তবায়ন ও সামাজিক সচেতনতা। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে নারীরা ভয় ও নিপীড়নমুক্ত সমাজে বেঁচে থাকতে পারে। অন্যথায়, প্রতিটি নারীকে আজীবন নিপীড়কের ছোঁয়া বয়ে বেড়াতে হবে।’
চলাফেরায় প্রতিনিয়ত নিরাপত্তার শঙ্কার কথা জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতেমা আলী বলেন, ‘নারী হিসেবে বর্তমানে চলাফেরা করতে গেলে হাজার বার ভাবা লাগছে, আমি ঠিক মতো ঘরে ফিরতে পারবো তো, আমার কিছু হবে না তো! এতো শত চিন্তা আর শঙ্কা নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। নারীকে ইসলাম ধর্মে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই নারীকেই রাস্তা ঘাটে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। নারীর প্রতি এমন লোভী-হিংস্র আচরণ চাই না, নারীকে নারী, মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান ও নিরাপত্তা দিতে হবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী ইংরেজি বিভাগের নওশিম আনজুম বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা শব্দটাই ঠুনকো আর তার সঙ্গে নারী শব্দটা যোগ করলে যেন তা খানিকটা হাস্যকরই শোনায়। একজন কর্মজীবী নারী, নারী শিক্ষার্থী, ষাটোর্ধ্ব নারী, গৃহবধূ কিংবা কন্যাশিশুসহ প্রত্যেকেই নিরাপত্তার প্রবল শঙ্কায় আড়ষ্ট। প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা প্রবাহ নারীর প্রাণোচ্ছ্বলতা উচ্ছ্বলতাকে নিস্তব্ধ করে দিচ্ছে। নারীদের দুর্বল মনে করে হেয় প্রতিপন্ন উপরন্তু কঠোর বিচারের অভাবই এসব হীনমন্যতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। ঘরে-বাইরে শারীরিক মানসিক নিযার্তন সহিংসতার অন্যতম নিয়ামক পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী বিদ্বেষী মনোভাব। কেবল মাত্র লোক দেখানো সভ্যতার নিদর্শন নয় বরং প্রতিটি দিনই নারীর চোখে বিশ্ব থাকুক শঙ্কামুক্ত।’
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুন নাহার রুমু বলেন, ‘নারী দিবস আসে প্রতি বছর, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— নারীদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সমানাধিকারের বিষয়গুলো কি শুধু এই একটি দিনে আলোচনার জন্য? আমাদের সমাজে এখনও নারীরা রাস্তায়, কর্মস্থলে, এমনকি নিজের বাড়িতেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। নারীদের নিরাপত্তা দিতে সমাজ রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তায় কঠোর আইন প্রয়োগ করা দরকার। শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবে না, একইসঙ্গে দরকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রযুক্তি যতই এগোক, মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া নারীদের জন্য নিরাপদ ও সমান সুযোগের সমাজ গড়া সম্ভব নয়। প্রত্যাশা একটাই—নারী দিবস উদযাপন যেন শুধু ফুল আর শুভেচ্ছায় সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং এটি হোক নারীদের প্রকৃত স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি।’
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রুমানি বলেন, ‘নারী দিবসের মূল উদ্দেশ্য নারীদের অধিকার, সমতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে বাস্তবে, নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। দেশের কোথাও নারীরা পুরোপুরি নিরাপদ না। সব বয়সের নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নারীর অধিকার রক্ষায় আইন থাকলেও তা যথোপযুক্ত নয়। এ কারণে নারী নির্যাতন, হয়রানি ও বৈষম্য রয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং নেতৃত্বে নারীরা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে এসেছে। সমাজ বা দেশকে এগিয়ে নিতে নারীরা তাদের নিজেদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চটুকু চেষ্টা করছে। কিন্তু দিন শেষে আমাদের সমাজে নারীদের নিরাপত্তায় ভুগতে হচ্ছে।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ফাবিয়া রহমান বৃত্তি বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে এবং যৌন হয়রানির মতো সমস্যা এখনও সমাজে বিদ্যমান, যা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ রোধ করছে। নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানি আজ একটি গুরুতর সমস্যা। বলা চলে এটি সমাজের ক্যানসার। শহর এবং গ্রামে নারীরা পাবলিক স্পেসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। বাংলাদেশে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে বরাবরই দায়িত্বশীলরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর সমাধান করতে হবে। যাতে রাস্তাঘাট, কর্মস্থল এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারীরা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। নারীদের অধিকার আদায়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির সময় এসেছে।’