প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
![]() |
১০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে ‘নোটিশ’ দেওয়া হয়েছিল | ছবি: সংগৃহীত |
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর ফলসী ইউনিয়নের একটি গ্রাম শড়াতলা। এই গ্রামে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের কারও প্রবেশও নিষেধ। নিয়মের ব্যত্যয় হলে জরিমানা করার নোটিশও দেওয়া হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, বাউল লালন শাহর জন্মভূমি এই হরিণাকুণ্ডু। এই বাউলসাধকের জন্মস্থানে এমন ঘটনায় চটেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, এটা বেআইনি।
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শড়াতলা। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ১০০ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্পের ফটোকপি সাঁটানো রয়েছে। তার প্রথম অংশে বড় করে লেখা, ‘সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও হকার নিষিদ্ধকরণের নোটিশ’।
ভেতরে লেখা রয়েছে, ‘গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে, সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করা হলো। যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে তাদের ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে এবং তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ হকার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নোটিশে আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘যেহেতু আমাদের গ্রামের ৯৫% মানুষ শিক্ষিত ও ২০ জনের মতো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছেন। নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে গ্রামবাসী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।’
নোটিশের শেষ অংশে ‘গ্রামবাসীর পক্ষে’ ১৯ জন স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি, শিক্ষক ও ইমাম।
নোটিশে সই করা শড়াতলা গ্রামের পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি এনামুল হক বলেন, ‘আগে আমাদের গ্রামে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো। এতে অসুস্থ মানুষ, শিক্ষার্থী, নারী, শিশুসহ অনেকের সমস্যা হতো। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বিভিন্ন সময়ে উচ্চ স্বরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচ-গান করেন। এতে মানুষের সমস্যা হয়। তাঁরা ও হকাররা নানা সময় মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেন। তাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তৌহিদুর রহমান বলেন, বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের কারণে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। তাই তাদের সুবিধার জন্য গ্রামের সবার মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফলসী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, ‘আমি অসুস্থ। ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছি। এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
খুলনা বিভাগের বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. নাজিম উদ্দিন জুলিয়াস বলেন, ‘একজন সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজের একজন সুধী মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করছি, এটা ঠিক নয়। ওই গ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যেতে পারবে না, তাদের অপরাধটা কী?’ তিনি আরও বলেন, ‘বাউলসম্রাট লালন শাহর জন্মভূমি হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে। সেই হরিণাকুণ্ডুর একটি গ্রামে এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। এটি আইনবিরোধী। এভাবে কেউ নিয়ম তৈরি করতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘গ্রামের পোস্টারগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য থানার ওসিকে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করে আইনগতভাবে যা যা করণীয় আমরা সেই পদক্ষেপ নেব।’
হরিণাকুণ্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ রউফ খান জানান, এ বিষয়ে কেউ এখনো লিখিত অভিযোগ দেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন। পরে ওই গ্রামে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখছি।