প্রতিনিধি খুলনা

কুয়েট ক্যাম্পাস থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাতেও | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে ক্যাম্পাসের আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এতে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এ সংঘর্ষের সূত্রপাত নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হয়েছে। ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধীদের ব্যানারে বের করা মিছিল থেকে প্রথমে আক্রমণ করা হয়। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরে কুয়েট এলাকার রেলিগেট, তেলিগাতিসহ আশপাশের বিএনপি নেতা–কর্মীরা ছাত্রদলের সঙ্গে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের নেতা–কর্মীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আহত ব্যক্তিদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েট মেডিকেল সেন্টারসহ আশপাশের বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ক্যাম্পাস সূত্র ও  প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুয়েট শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। গতকাল সোমবার তারা ক্যাম্পাস এলাকায় লিফলেট বিতরণ করে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে মিছিল বের করেন। এ সময় তাঁরা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘এই ক্যাম্পাসে হবে না, ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে ছাত্র হলগুলোর সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করেন। পরে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছালে ছাত্রদলের নেতা–কর্মীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হন। সংঘর্ষে আহত ব্যক্তিদের কুয়েটের অ্যাম্বুলেন্সে করে একের পর এক হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সন্ধ্যার পরও অ্যাম্বুলেন্সে করে আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নিতে দেখা যায়।

ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা বলেন, ‘গতকাল ছাত্রদলের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে ছাত্রদলের ফরম বিতরণ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজ (মঙ্গলবার) সমাবেশ ডেকেছিলাম। আমরা উপাচার্যের কাছে একটি আবেদন করার কথা ভেবেছিলাম যে এই ফরম বিতরণের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের যেন বহিষ্কার করা হয় এবং ভবিষ্যতে যেন কুয়েটে কেউ কোনো ছাত্রসংগঠন না করতে পারেন।’

ওই নেতা বলেন, ‘আমরা আজ যখন উপাচার্যের কাছে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের কুয়েটের ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত, এ রকম কয়েকজন বাইরে থেকে আরও ১৫-২০ জনকে নিয়ে আসেন। তাঁরা আমাদের কটূক্তি করতে থাকেন এবং আমাদের কয়েকজনকে আক্রমণ করেন। এরপর আমরা তাঁদের ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়ে মেইন গেট ও পকেট গেট আটকে দিই। এরপর ছাত্রদলের ছেলেরা পকেট গেটে এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন এবং স্লোগান দিতে থাকেন। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা পকেট গেটে জড়ো হই। বাইরে থেকে ছাত্রদলের ছেলেরা এবং স্থানীয় কিছু লোকজন এবং হেলমেট পড়া আরও অনেকে আমাদের ওপর তখন ইটপাটকেল ছোড়েন। রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁরা আমাদের আক্রমণ করতে আসেন। এতে আমাদের অনেকে আহত হন। মূলত এভাবেই ঘটনার সূত্রপাত।’

তবে ছাত্রদলের পক্ষে কুয়েটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাহুল জাবেদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলের সামনে থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। এতে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটা ২০-২৫ মিনিট ধরে চলতে থাকে। এরপর আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রশিবিরের সমর্থক যারা আছে, তারা আমাদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে এবং বাইরের দোকানদারদের ওপর আক্রমণ করে। বাইরের লোকজন এটা মেনে নিতে পারেনি। এভাবেই ঘটনার সূত্রপাত হয়।’

কুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাফওয়ান আহমেদ ইফাজ জমাদ্দার বলেন, ‘তারা মিছিল করছিল রাস্তায়, আমরা ২৫-৩০ জন মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় মিছিল থেকে আমাদের ধাওয়া করা হয়। আমাদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়া হয়। এরপর পকেট কেটে এসে তারা স্থানীয় দোকানপাটেও ক্ষতি করে। তখন সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়।’

খুলনা মহানগর ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সদস্যসচিব তাজিম বিশ্বাস বলেন, ‘ছাত্রশিবির এবং পতিত সরকারের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের যেসব নেতা-কর্মী এখনো আছে, যাদেরকে আমরা চিনি, তারাই মূলত আমাদের ছাত্রদলের নেতা–কর্মীদের ওপর প্রথমে হামলা করেছে।’

অভিযোগ অস্বীকার করে খুলনা মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি আরাফাত হোসাইন মিলন গণমাধ্যমকে বলেন, কুয়েটের ঘটনার সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদল ও বিএনপি নেতা–কর্মীরা হামলা চালিয়ে অনেককে আহত করেছেন বলে তিনি শুনেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুয়েটের সদস্যসচিব জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গুরুতর আহত ৫০ জন শিক্ষার্থী। কমবেশি আহত ধরলে আহত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০–এর বেশি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ ফেসবুকে পোস্টে লিখেছেন, ‘কুয়েটে ছাত্রদল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ স্টাইলে যে নৃশংস হামলা চালাচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল নিজেদের রাজনৈতিক কবর রচনার পথেই অগ্রসর হলো।’

খুলনার খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

উল্লেখ্য, গত ১১ আগস্ট সিন্ডিকেট সভায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।