নিজস্ব প্রতিবেদক
![]() |
মিরপুরে সেনাবাহিনীর টহল। ৩০ ডিসেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার প্রেক্ষাপটে অভিযানকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নাম দিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার কথা বলছে সরকার ।
ডেভিল হান্ট অভিযানের আওতায় কারা পড়বেন--জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'আপনারা ডেভিল শব্দটার অর্থ তো জানেন—শয়তান। যারা শয়তান, তাদেরই ধরা হবে। এখন ছোট শয়তান নাকি বড় শয়তান, সেটা দেখব না।’
তবে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দমনে এ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা।
সোমবার বিকেল পর্যন্ত গত দুই দিনে সেনা, পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর অভিযানে কমপক্ষে এক হাজার ৬৫১ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক।
জানতে চাইলে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এর সমন্বয়কারী পুলিশ কর্মকর্তা আবু নাসেদ মোহাম্মদ খালেদ বিশেষ এই অভিযানের আওতায় আটক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া শত শত ব্যক্তির মধ্যে একটি তালিকা পেয়েছে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত দুই দিনে কমপক্ষে ২৩৮ জন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, 'ভেঙে পড়া আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সামলাতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলাকালে নতুন কর অপারেশন ডেভিল হান্ট কেন শুরু করতে হলো-তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া শুধু একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী বা সমর্থক হওয়ার জন্য গণহারে আটক করার ঘটনা ঘটলে তা হবে দুঃখজনক।'
অজ্ঞাত স্থান থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, 'আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং এমনকি সহানুভূতিশীল ভোটার, যারা কোনো দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে না-‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর নামে তাদের আটক করা হচ্ছে। তারাই (বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা) আসল ডেভিল-এটা গাজীপুরের ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। সেসব ডেভিলদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে সরকার। এই অপারেশনের নামে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলছে। এভাবে আওয়ামী লীগকে দমিয়ে রাখা যাবে না। ঐতিহাসিক এই দলটি আবারো পুনরুজ্জীবিত হবে।'
এদিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন এবং সারা দেশে অবস্থিত তার পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
জানুয়ারির শেষের দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের দাবিতে ফেব্রুয়ারি জুড়ে লিফলেট বিতরণ, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল, অবরোধ এবং সাধারণ ধর্মঘটসহ মাসব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ।
পরে ৫ ফেব্রুয়ারি দলের সভাপতি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ছাত্র সংগঠনের সভায় ভাষণ দেবেন বলে জানায় নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠনটি। এর প্রায় এক ঘন্টা আগে তার পিতার বাসভবনে ভাঙচুর ও হামলা শুরু হয়।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে এই হামলার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়ী করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই হামলার দায় নিতে হবে। যেখানেই হামলার ঘটনা ঘটুক না কেন, তা বন্ধ করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু সেটা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।'
এদিকে গত শুক্রবার রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধ–বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পরদিন থেকে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, 'সেনা, বিমান এবং নৌ বাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, আনসার এবং কোস্টগার্ড সদস্যরা যৌথভাবে এই অভিযান পরিচালনা করবে।'
সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ডেভিলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলবে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, 'এই অপারেশনটা চলবে তত দিন পর্যন্ত, যত দিন পর্যন্ত ডেভিল এখান থেকে মুক্ত না হবে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'ডেভিল হান্ট ঘোষণা করার পর আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। প্রথম দিনই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে বড়–ছোট কোনো ভেদাভেদ নেই। যে আসবে এই জালে, সে ধরা পড়বে।'
তবে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'অপারেশন ডেভিল হান্টের নামে ঢালাওভাবে বিরোধী মত দমন চলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। একইসাথে বিপুলসংখ্যক গায়েবী মামলা দেয়া হচ্ছে।'
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী সাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীসহ নিরাপরাধ জনগণের উপর জুলুম ও হয়রানি বন্ধের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ঘটনার গতিপ্রকৃতি, সময় ও ঘটনাস্থলের অবস্থান বিবেচনা করে বিভিন্ন অভিযানের নাম দেওয়া হয়।
![]() |
দেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে দেখছে বাংলাদেশের স্কুলের মেয়েরা। ঢাকা। ৬ ফেব্রুয়ারি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
২০০২ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর অপারেশন ক্লিনহার্ট শুরু হয়, যা ছিল মূলত সেনা অভিযান। গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত অভিযান ছিল সেটি।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানেরও নানা নামকরণ হয়েছে। কোনোটি অপারেশন থান্ডারবোল্ট, কোনোটি অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ কোনোটি আবার অপারেশন স্টর্ম ২৬।
তবে অপারেশন ডেভিল হান্টের নামকরণ নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার কর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর বলেন, “অপারেশনটির এই নাম কীভাবে ঠিক করা হয়েছে জানি না। তবে এ ধরনের নাম নাগরিকের জন্য অমর্যাদাকর। আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের আছে। অথচ বিচারের আগে এ ধরনের নামে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা অন্যায়।”
শিগগিরই আ.লীগকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, 'রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।'
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসিফ মাহমুদ বলেন, 'প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের ‘ঐকমত্য’ তৈরি হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'দেশের মানুষ তৎকালীন ক্ষমতাসীন ওই দলের অগণতান্ত্রিক এবং একগুয়েমী মনোভাব ও কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি বলেই ৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের মধ্যে দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ‘ঐকমত্য’ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য তৈরি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।'