দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। আবার সবচেয়ে বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতও এটি। কিন্তু এই খাতে অর্থায়ন, নীতিমালা ও পণ্য বাজারজাতকরণে সমস্যা রয়েছে। তাই সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এসএমই খাতকে এগিয়ে না নিলে সার্বিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আজ বুধবার ‘এসএমই নীতিমালা ২০২৫ প্রণয়নে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এ কথা বলে বক্তারা। এসএমই ফাউন্ডেশন ও অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) যৌথভাবে কর্মশালাটির আয়োজন করে।

রাজধানীর পল্টনে ইআরএফের কার্যালয়ে সংগঠনটির সভাপতি দৌলত আকতার মালার সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ ও এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

কর্মশালায় বলা হয়, বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নে ২০১৯ সালের নীতিমালার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শিল্প মন্ত্রণালয় এসএমই নীতিমালা ২০২৫ তৈরি করছে। তবে এই নীতিমালা বাস্তবায়নে নজরদারির পাশাপাশি বাস্তবায়নের সহযোগী মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহের অনুকূলে বাজেটে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারে বৈশ্বিকভাবে অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি হতে পারে। তখন অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের জন্য এসএমই খাতে আসবেন। সে জন্য এসএমই খাতের উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। এসএমই খাত ঠিক পথে না গেলে পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এসএমই ফাউন্ডেশনের এমডি আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ছোট পরিসরে পণ্য তৈরি করে। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, দেশের করপোরেট কোম্পানিগুলোও এসএমইদের এসব পণ্যের ব্যবসায়ে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু বড় কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না এসএমই উদ্যোক্তারা। এ জন্য উপযোগী নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে এসএমই খাতকে টেনে তুলতে হবে। শুধু করপোরেট খাত দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, এসএমই খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থায়নের অভাব। এ ছাড়া সুদের উচ্চহার, পর্যাপ্ত নীতিমালার অভাব ও পণ্য বাজারজাতকরণের সমস্যা রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে কমপক্ষে ৩১টি নথি প্রয়োজন হয়। এসব কারণে এসএমইরা পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে এসএমই ঋণের বড় অংশই পান মাঝারি ব্যবসায়ীরা। কারণ, এই ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজ সংগ্রহ করা কটেজ ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ কারণে এসএমই নীতিমালার নাম সিএমএসএমই করা এবং কটেজ ও মাইক্রোকেও আবশ্যকীয়ভাবে ঋণের আওতায় যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।

সম্প্রতি সরকারের ভ্যাট বৃদ্ধির পদক্ষেপের সমালোচনা করেন তাসকিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকার প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে আপামর জনগণের ওপর ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এসএমই খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনা গেলে এখান থেকেও প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো সম্ভব।

খসড়া নীতিমালায় যা আছে
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। এসএমই নীতিমালা ২০২৫-এর খসড়ায় নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এর মধ্যে রয়েছে—অপ্রাতিষ্ঠানিক এমএসএমই খাতের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ; সার্কুলার ইকোনমি বা চক্রায়ন অর্থনীতিভিত্তিক শিল্পায়ন, শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ১০ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় এমএসএমই দিবস ঘোষণা করা। পাশাপাশি গ্রিন বন্ড, গ্রিন ইক্যুইটি ও অরেঞ্জ বন্ডের মাধ্যমে এসএমই ও নারীদের জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া; এসএমইদের জন্য অ্যাঞ্জেল ফান্ড চালু এবং ক্রাউড ফান্ডিং সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।

এসএমই খাতের বিভিন্ন অংশীজনের জন্য কয়েক ধরনের স্বীকৃতির সুপারিশও করা হয়েছে খসড়ায়। যেমন প্রতিবছর বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সম্ভাবনাময় এসএমই উদ্যোক্তাদের এসএমই চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড প্রদান, সর্বাধিক এসএমই ঋণ প্রদানকারী ব্যাংককে স্বীকৃতি দেওয়া এবং এসএমই খাত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের পুরস্কার প্রদান ইত্যাদি।

এসএমই নীতিমালা ২০২৫ বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি; নীতিমালা ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো, এসএমই ফাউন্ডেশনকে আর্থিকভাবে শক্তিশালীকরণ এবং ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠানটির কিছু কার্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।