উদয় সিনা
বল পায়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল | ছবি: সংগৃহীত |
একাত্তরের উত্তাল মার্চে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালির মতো পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নওগাঁর জাকারিয়া পিন্টু। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পরিবর্তে একটি নবগঠিত ফুটবল দলে যোগ দেন তিনি। দলটা ‘বাংলাদেশ একাদশ’ নামে আত্মপ্রকাশ করলেও মানুষের ভালোবাসায় সবার মুখে মুখে এর নাম হয়ে যায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যখন প্রস্তুত হচ্ছিল লাখো কোটি বাঙালি, ঠিক তখনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। অস্ত্র বা গ্রেনেড হাতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে নয়, মাঠে ফুটবল খেলার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রাখে এ দলটি। এর আগে কোনো দেশের মুক্তিযুদ্ধে কোনো ফুটবল দলের অবদান রাখার এমন নজির পৃথিবীতে আর একটিও ছিল না।
মূলত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি এবং তহবিল গড়তেই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হয়। তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং পিডব্লিউডির ফুটবলার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান প্যাটেলের চিন্তা ও পরিকল্পনার ফসল এই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। কলকাতার বালিগঞ্জে কোনো এক রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে প্যাটেলের মাথায় একটা ভাবনা আসে। ফুটবল খেলেও যে যুদ্ধে অবদান রাখা যায়, সেই ভাবনাকে সঙ্গে করে আট নম্বর থিয়েটার রোডে তিনি দেখা করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। সেখানে নিজস্ব পরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা ফুটবল দল গঠনের প্রস্তাব রাখেন তিনি। ওই পরিকল্পনায় আশ্বস্ত হয়ে দল গঠনের অনুমতির পাশাপাশি প্রাথমিক খরচের জন্য প্যাটেলের হাতে ১৪ হাজার রুপি তুলে দেন তাজউদ্দীন। এতে করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের কাজটা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়।
দল গঠনের পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শে কলকাতার পার্ক সার্কাসে একটি কমিটি তৈরি করা হয়, যার নাম ছিল ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে পৃষ্ঠপোষক, শামসুল হককে প্রথম সভাপতি, আশরাফ আলী চৌধুরীকে দ্বিতীয় সভাপতি, এম এম চৌধুরী কালুকে তৃতীয় সভাপতি, লুৎফর রহমানকে সেক্রেটারি, মোহাম্মদ মহসিনকে ট্রেজারার, এম এ হাকিম, আবদুল মতিন ও মুজিবর রহমান ভুঁইয়াকে সদস্য করে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন গঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি।
তারপর প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) অনুমতি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শুরু হয় দল গোছানোর কাজ। তখন প্যাটেল-পিন্টুর মতোই হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধের ময়দানে নামার প্রস্তুতি সারছিলেন অনেক ফুটবলার। কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আগরতলায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খেলোয়াড় সংগ্রহের ঘোষণা শুনে ওই জায়গাগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফুটবলাররা এসে একত্র হন পার্ক সার্কাসে। পরে তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্নাকে ম্যানেজার, ননী বসাককে কোচ, প্রতাপ শঙ্কর হাজরাকে সহ-অধিনায়ক ও জাকারিয়া পিন্টুকে অধিনায়ক করে মোট ২৪ জনকে নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে চলে যাওয়া এবং ইনজুরিতে পড়া ফুটবলারদের বিকল্পদের নিয়ে সব মিলিয়ে দলটার সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭–এ।
১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই কৃষ্ণনগরে নদীয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলতে মাঠে নামে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। ম্যাচটা ২-২ গোলে ড্র হয়। এ ম্যাচের আগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফুটবলারদের এক বিপত্তি বেধে যায়। ফুটবলাররা ম্যাচের পূর্বে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলে ভারত সরকারের স্বীকৃতি না থাকায় লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলনে অস্বীকৃতি জানায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তাতেই বেঁকে বসেন ফুটবলাররা। পিন্টু-প্যাটেলরা সাফ জানিয়ে দেন, পতাকা তুলতে না দিলে তাঁরা খেলবেন না। পরবর্তী সময়ে মাঠে উপস্থিত ৩০ হাজার দর্শকের দিকে তাকিয়ে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া হয় এবং ম্যাচের আগে জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শঙ্কর হাজরার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা হাতে পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করে গোটা দল।
আসলে পতাকা ওড়ানোর বিশেষ অনুমতিটা আসে নদীয়া জেলা প্রশাসক ডিকে ঘোষের কাছ থেকে। তিনি দলের ম্যানেজারকে জানিয়ে দেন, শুধু খেলোয়াড়রা মাঠে পতাকা ওড়াতে পারবেন। কর্মকর্তারা নন। সে সময় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর ঘটনাটা পুরো ভারতেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সবুজ সংকেত ছাড়া পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেওয়ায় ডিকে ঘোষের চাকরি পর্যন্ত চলে যায়। পরে অবশ্য তাঁকে আবার চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়।
ভারতে খেলা মোট ১৬টি ম্যাচের মধ্যে ১২টি জয়, ৩টি ড্র ও ১টি পরাজয় ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের। সেখান থেকে অর্জিত ৫ লাখ মতান্তরে ১৬ লাখ ৩০ হাজার রুপির পুরোটাই তখন মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে দিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, এ টাকা দেওয়ার আগপর্যন্ত সে ফান্ড শূন্য ছিল। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাস্ত্র কিনতে টাকাগুলো কাজে লাগানো হয়।
ভারতে অবস্থানকালে মাঠে লড়াই করার পাশাপাশি মাঠের বাইরেও লড়তে হয়েছে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রত্যেক সদস্যকে। সেখানে টিকে থাকতে তাঁদের রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পার্ক সার্কাসের কারনানি ম্যানশনের ১৭ নম্বর ফ্ল্যাটটিতে ভাড়া থাকতেন দলের প্রত্যেক সদস্য। সেখানে সব খেলোয়াড়ের জন্য শুধু একটি এবং অফিশিয়ালদের জন্য ভিন্ন একটি কক্ষ বরাদ্দ ছিল। প্রায় ২৫ জন ফুটবলার থাকতেন এক কক্ষের মেঝেতে, ব্যবহার করতেন একটি শৌচালয়। এতে করে একদিন তো এক মহাবিপত্তিই ঘটে গেল!
গোষ্ঠপাল একাদশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচের দিন ভুলবশত বেসিনের কল ছেড়েই মাঠে চলে যান ফুটবলাররা। সন্ধ্যায় ফিরে এসে তাঁরা দেখেন, পুরো ঘর পানিতে ভেজা। লেপ, তোশক, বালিশ, কাপড়চোপড় সব ভিজে একাকার। ফলে মেঝেতে গা পাতা অসম্ভব হয়ে পড়ল। ব্যস, সবাই মিলে রাতে বেরিয়ে গেলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবরের কাগজ সংগ্রহ করতে লাগলেন। তারপর সেগুলো বিছিয়ে স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতেই গা এলিয়ে কাটিয়ে দিলেন রাতটা।
বসবাসের পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ায়ও বেশ ভুগতে হয়েছিল খেলোয়াড়দের। তিন বেলা খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে পর্যন্ত হিমশিম খেতেন ফুটবলাররা। অথচ দিনে মাত্র দুই বেলা খেয়েও কঠোর অনুশীলনে কোনো খামতি রাখতেন না তাঁরা। শুধু দেশের প্রতি অসীম ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁরা হাসিমুখে সহ্য করেছিলেন এসব প্রতিবন্ধকতা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদান রাখতে পারায় বরাবরই গর্ব করে থাকেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা। তবে গর্বের পাশাপাশি তাঁদের প্রত্যেকের একটা আক্ষেপও রয়েছে। যুদ্ধজয়ের ৫৩ বছর পরও যে দলগতভাবে কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাননি তাঁরা!
এ আক্ষেপকে সঙ্গে করেই ইতোমধ্যে অমলেশ, নুরুন্নবী, আইনুল, নওশেরুজ্জামান, প্যাটেল, পিন্টুসহ দলের বেশ কয়েকজন পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। জীবিত অবস্থায় বাকিদের আক্ষেপ আদৌ মিটবে কি না, তারও নেই নিশ্চয়তা। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা দেশের জন্য যা করেছেন, সেটা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসে ও বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
একনজরে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শঙ্কর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), শেখ মোহাম্মদ আইনুল হক, সাইদুর রহমান প্যাটেল, আলী ইমাম, শাহজাহান আলম, শেখ আশরাফ আলী, এনায়েতুর রহমান খান, খন্দকার নুরুন্নবী, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, সুভাষ চন্দ্র সাহা, অমলেশ সেন, মোহাম্মদ শেখ তসলিম উদ্দিন, এ কে এম নওশেরুজ্জামান, মনসুর আলী লালু, তূর্য হাজরা (কাজী সালাউদ্দিন), আবদুল হাকিম, বিমল কর, ফজলে সাদাইন মৃধা খোকন, মুজিবর রহমান, লুৎফর রহমান, সাঈদ, নিহারকান্তি দাস, দেওয়ান সিরাজউদ্দিন সিরু, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, বীরেন দাস বীরু, প্রাণগোবিন্দ কুণ্ডু, অনিরুদ্ধ চট্টোপাধ্যায়, আবদুস সাত্তার মিয়াঁ, মোজাম্মেল হক, সনজিৎ কুমার দে, আবদুল খালেক, আবদুল মোমিন জোয়ার্দার, মাহমুদুর রশীদ ও আমিনুল ইসলাম সুরুজ।
কোচ: ননী বসাক।
ম্যানেজার: তানভীর মাজহারুল ইসলাম তান্না।