আফসান চৌধুরী

দিনাজপুরে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে উচ্ছ্বসিত মুক্তিযোদ্ধারা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ | ছবি: অমিয় তরফদার

২০০১ সালে বিবিসি রেডিওর জন্য ‘বাংলাদেশ একাত্তর’ শিরোনামে আমি একটি সিরিজ করি। সেই সুবাদে ১৯৭১ সালে যৌথ বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার দিল্লির বাসভবনে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিই। তাঁকে খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছিল। ভারতীয় সরকারি মহলে তাঁকে নিয়ে আগ্রহ ছিল না। পরে জানতে পারলাম, খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে তাঁর ব্যাপারে একটু ‘দূরে থাকো’ নীতি চালু হয়।

যা–ই হোক, যখন টেপরেকর্ডার ঠিক করছি, তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে যৌথ বাহিনীর কথা, যুদ্ধের কথা। কেউ কিন্তু এই কথাটা জিজ্ঞেস করে না, বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ যদি আমাদের ইজাজত (অনুমতি) না দিত, তাহলে কি আমরা ঢাকাকে মুক্ত করতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারতাম?’

খুবই মৌলিক একটা প্রশ্ন। এ রকম অনেক মৌলিক প্রশ্ন এভাবে হারিয়ে গেছে আমাদের ইতিহাস নিয়ে।


ইতিহাসচর্চা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আমরা এখনো ঠিক করতে পারিনি, কেন ইতিহাসচর্চা করতে চাই? মানুষকে শিক্ষিত করতে, ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করতে, তথ্য চর্চা করতে, নাকি রাজনীতি করতে। এত বই লেখা হলো, কিন্তু ৫৩ বছর পরও একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে ঝগড়া থামল না।

এর কারণ কী? ইতিহাসচর্চার পদ্ধতিগত দুর্বলতা? নাকি এর হেতু আরও গভীরে, যা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রোথিত, যা থেকে মুক্ত হতে পারি না?


চারদিকে আলাপ করে যা বুঝি, একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমেছে। যাঁদের আছে, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে এর সঙ্গে জড়িত—দেহ, মন, মনন বা চিন্তায়; অথবা এর থেকে সুবিধা পেয়েছেন বা অসুবিধা ভোগ করেছেন। তাঁদের সংখ্যা স্বল্প। বাকিদের এটি নিয়ে আগ্রহ কম। হলেও চলে, না হলেও চলে।

বেশির ভাগ মানুষের কাছে একাত্তর যেন একটি সরকারি আয়োজনের অংশ—আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বেশি, অন্যরা ক্ষমতায় থাকলে কম। এবারও যেমন খুবই কম।

অনেকের কাছে একাত্তরের ইতিহাস মানে রাজনীতির বিষয়—ঝগড়া, বিবাদ, টক শো ইত্যাদি। এসব বিষয় নিয়েও মানুষের আগ্রহ কম।



ইতিহাসচর্চা মানে নির্মোহভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ। প্রশ্ন হলো, আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় কি এভাবে ইতিহাস চর্চা করা সম্ভব? এটা তো দেশ ‘স্বাধীন করা’র ইতিহাস, কাজেই এতে কি ‘দেশপ্রেমচর্চা’ ছাড়া অন্য কিছুর জায়গা হতে পারে?

আমরা সবাই এই দেশের নাগরিক। এই পক্ষপাত অনিবার্য। কিন্তু এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো দেশ আর রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনেক সময়ই আমরা ব্যবধান মুছে ফেলি। ফলে কোনো না কোনো রাজনৈতিক পক্ষের ইতিহাস রচিত হয়, সবার জন্য নির্ভরযোগ্য ইতিহাস নয়। রাজনীতি আগে চলে আসে। ইতিহাস থাকে পেছনে পড়ে।


একাত্তরের ঘটনাকে আমরা বলি ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, গ্রামের কিছু কিছু মানুষ বলে ‘গন্ডগোলের বছর’, কেউ আবার বলে ‘ব্যর্থ বিপ্লব’ ইত্যাদি। অর্থাৎ একই ঘটনার একাধিক শিরোনাম। এটাই স্বাভাবিক। দেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের একাধিক পরিসর থাকে, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এ কারণে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। তবে মূল তথ্যের জায়গা নিয়ে তো সাধারণত সংশয় থাকার কথা নয়।

‘স্বাধীনতা’ মানে প্রধানত রাষ্ট্রকে স্বাধীন করা। ‘মুক্তি’ মানে প্রধানত সমাজকে মুক্ত করা। রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ই থাকে একটি দেশের বাস্তবতায়। তাই একটি দেশের একাধিক ইতিহাসের পরিসর থাকে। রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা, সমাজ অপ্রাতিষ্ঠানিক আবহমানতা। আর এই দুইয়ের মাঝখানেও থাকে উপপ্রাতিষ্ঠানিক নানা বিষয়। রাষ্ট্র, সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, গ্রাম, শহর, জনগণ ও শত্রুদল ইত্যাদি সব পরিসরে এটি সম্পৃক্ত, অথচ স্বতন্ত্র। আর এই সব রকমের বাস্তবতা ও ধারা মিলেই একটি দেশের ইতিহাস রচিত হয়।

আমাদের দেশে একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে যে দ্বন্দ্ব বা ঝগড়া হয়, তা মূল তথ্য নিয়েই। আর সে ঝগড়া চলে প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রিক ইতিহাসের ঘেরাটোপে। এর কারণ রাজনীতি ও রাষ্ট্র একসঙ্গে বসবাস করে।


১৯৭১ সাল আমাদের কাছে একধরনের ন্যায়যুদ্ধ। ফলে তা আলোচনা–সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। সব দেশেই এ রকম ঘটে, তবে এতটা নয়। এ দেশে একাত্তরের যাঁরা প্রধান প্রধান চরিত্র, তাঁরাও কেউ এক গোষ্ঠীর কাছে পবিত্র, কিন্তু অন্য গোষ্ঠীর কাছে শত্রু। এ কারণে ঘটনাটি নিয়ে তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনামূলক আলোচনার পরিসর আমাদের মধ্যে নেই।

এ দেশে ইতিহাসের প্রয়োজন হয় প্রধানত রাজনৈতিক কারণে, বিদ্যাচর্চার প্রয়োজনে নয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই বিপাক।


বাংলাদেশে যে একাত্তরে গণহত্যা ঘটেছে, তার প্রমাণ রয়েছে। তার জন্য সংখ্যাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই, দরকার তথ্য। ইংরেজ আমল থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে দীর্ঘ রাষ্ট্রিক বা সমাজ–রাজনৈতিক–ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, তা নিয়ে আলাপ হয় সামান্য। কে কখন কী ঘোষণা করল, তা নিয়েই তর্ক চলে বেশি। প্রতি শাসক দল পাল্টানোর পরে ইতিহাসের নতুন বই লেখা হয়। এর উদ্দেশ্য রাজনীতিতে সুবিধাজনক ইতিহাস জরুরি, তথ্যনিষ্ঠ বিদ্যাচর্চা নয়।

শাসক দলভিত্তিক ইতিহাসচর্চাই এখন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। এটাই ধারাবাহিক বাস্তবতা। প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রিক পরিসরে পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থাপনাও এই নিয়মেই প্রতিষ্ঠিত।


প্রতিটি ইতিহাসের একাধিক পরিসর থাকে—রাষ্ট্রিক, সামাজিক, আরও বহু। এসব ইতিহাসের স্রোতোধারা মিলেই গড়ে ওঠে একটি দেশের বিপুল ইতিহাস। অথচ আমাদের ইতিহাস রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, এখানে সামাজিক ইতিহাস নেই। এর ফলে একাত্তরের ইতিহাসে আমরা রাজনীতিবিদ, সমরবিদ, যোদ্ধা, আমলা, সাংবাদিক ও প্রবাসী নেতাদের দেখি। সাধারণ মানুষকে কখনো দেখি না। যাঁরা রাজনীতি করেন, তেমন অল্প কজনই ইতিহাসে আছেন; বাদ বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আর নেই।

আমাদের একাত্তরের ইতিহাসচর্চায় সামাজিক ইতিহাস এবং বিভিন্ন জনপদ ও গোষ্ঠীর ইতিহাস–অধ্যয়ন প্রায় নেই বললেই চলে। আমাদের মৌলিক সমীকরণ হচ্ছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রকাঠামো ও রাষ্ট্রপন্থী রাজনীতি।

আমাদের ইতিহাসবিদেরাও এই বৃত্তের অংশ। এ কারণে এটাই মূলধারা হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের ইতিহাস আছে, আবার সেটা নিয়ে বিবাদও আছে। অথচ সমাজের ইতিহাস নেই, কারণ সমাজ রাষ্ট্রিক ক্ষমতার ভাগাভাগির অংশীদার নয়। তাই সেই ইতিহাসে ‘পাবলিক’ (জনগণ) নেই। তাই পাবলিকের আগ্রহও নেই।


বাস্তবতার ভিত্তিতে আমার আন্দাজ হচ্ছে, অনেক দলিল হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে, ইন্দো-পাকিস্তানি দলিলসহ অনেক নথি আর পাওয়া যাবে না; ফলে আমাদের রাষ্ট্রিক ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। কিন্তু এসব নিয়ে বিবাদ চালু থাকবে, কারণ এই বিবাদের ভিত্তি ইতিহাস নয়, রাজনৈতিক উপযোগিতা।

সামাজিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে বড় সংকট হলো, সাক্ষ্য দেওয়ার মতো মানুষেরও বড় অংশ এখন মৃত। বাকিদের স্মৃতিও প্রায় কবরে চলে গেছে। উপরন্তু আছে নানা চাপ। তাই ভালোভাবে একাত্তরকে জানা হয়ে পড়েছে অসম্ভব কঠিন। কিছু লোক নিজ উদ্যোগে কিছু করতে পারেন, তবে দুঃখজনকভাবে মোটাদাগে আমরা অনেকটাই ইতিহাস না–জানা এক জনগোষ্ঠীতে পর্যবসিত হয়েছি। আরও দুঃখজনক হলো, তাতে কারও কিছু এসে–যাচ্ছে বলেও মনে হচ্ছে না।

● লেখক: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস–গবেষক