বিশেষ প্রতিবেদক

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে- এই ঘোষণা দেওয়ার চার দিনের মাথায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে। সাবেক আমলা এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে এই কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে।

যদিও নির্বাচনের তারিখ এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে নতুন ইসি গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো। তারা আশা করছে, কমিশন দ্রুতই নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এগোবে।

এর আগে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সাত মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক মাস পর কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করে, যার ফলে সাংবিধানিক সংস্থাটি কার্যত শূন্য হয়ে পড়ে। সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করেই ভোট আয়োজনের পথে এগোচ্ছে।

নির্বাচনী সংস্কার ত্বরান্বিত করতে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই দুই বছর আগে প্রণীত আইন অনুসরণে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।

নতুন ইসি নিয়ে বিএনপি আশাবাদী। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, "কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন মুখ্য কাজ দ্রুত নির্বাচন আয়োজন। এর কোনও বিকল্প নেই।"

তিনি আরও বলেন, "সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও তৎপরতা দেখানো উচিত। দীর্ঘ ১৭ বছরের কলঙ্ক মিটিয়ে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা নতুন ইতিহাস রচনা করবে। বিএনপি এই প্রক্রিয়ায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।"

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করে দলীয় সরকারের অধীনে তিনটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে। সেই নির্বাচনের দুটিই বিএনপি বর্জন করে এবং একটিতে অংশ নিলেও কারচুপির অভিযোগ তোলে।

নতুন নির্বাচন কমিশন সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে বলে আশা করছে দেশের জনগণ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোট দিচ্ছেন একজন তরুণ ভোটার। বরিশালের জগদীশ সারস্বত গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে  | ফাইল ছবি

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের পর রাজনৈতিক দলগুলো মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দলীয় নিবন্ধন হারানোর কারণে গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারা জামায়াতে ইসলামী এখনও তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও প্রচার বিভাগের সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, “সাংগঠনিকভাবে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা আলোচনা করে শিগগিরই আমাদের অবস্থান জানাব।” তবে তিনি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, “অপরিহার্য সংস্কার করেই নির্বাচন করতে হবে। কারণ বর্তমান সরকার সব সংস্কার করতে পারবে না।”

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নতুন ইসির কার্যক্রম দ্রুত শুরুর পক্ষে। দলের সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “যাদের সরকার নিয়োগ দিয়েছে, নিশ্চয়ই তারা যোগ্য। আমরা আশা করি, নতুন কমিশন কাল থেকেই কাজ শুরু করবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।”

সদ্য নিবন্ধনপ্রাপ্ত আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) নতুন ইসির ওপর আস্থা প্রকাশ করেছে। দলটির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “নির্বাচন কমিশনার অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি। বাকিরাও নিশ্চয়ই যথাযথ। তবে দক্ষ প্রশাসনের অভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ থাকবে। ইসিকে ভোটার তালিকা ও অন্যান্য বিষয় ঠিকঠাক করতে হবে।”

জাতীয় পার্টি নতুন ইসি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে রাজি হয়নি। দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “আমরা দলীয়ভাবে আলোচনা করে দুই-এক দিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানাব।”

অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ইসি গঠন নিয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। দলের ফেসবুক পেজে অন্যান্য বিষয়ে বিবৃতি এলেও নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে তারা নিরব রয়েছে।

নতুন ইসির গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চললেও সবাই এখন তাকিয়ে আছে কমিশনের কার্যক্রম ও নির্বাচনী প্রস্তুতির দিকে।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত: সিইসি নাসির উদ্দীন

নতুন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন | ফাইল ছবি

নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নাসির উদ্দীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সংকল্প প্রকাশ করেছেন।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সুষ্ঠু, অবাধ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়াই আমার মূল লক্ষ্য। সেটি বাস্তবায়নে যা যা করার প্রয়োজন, আমি তাই করব। সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে একটি সুন্দর ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের।”

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, “জীবনে চ্যালেঞ্জ থাকবেই। আমার চাকরিজীবনও ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। তথ্য মন্ত্রণালয়, জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছি। সবক্ষেত্রেই নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। তাই চ্যালেঞ্জকে ভয় পাই না।"

তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতে হয়তো আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। তবে সকল অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাব। এই বিশ্বাস আমার রয়েছে।”

নাসির উদ্দীন বিসিএস ৭৯ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি ২০০৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। তার বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করেছেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি দেশের চতুর্দশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নাসির উদ্দীনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তার সঙ্গে চারজন নির্বাচন কমিশনারও নিয়োগ পেয়েছেন:

মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান।

আবদুর রহমান মাসুদ: অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ।

তহমিদা আহমদ: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা।

আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পাকিস্তানের ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন।

নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন | ফাইল ছবি

নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
গত রোববার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “নির্বাচন কবে হবে—এই প্রশ্ন সবার মনেই রয়েছে। আমাদের মনেও এটি সারাক্ষণ কাজ করছে।"

তিনি জানান, নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। “কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে। তারপর থেকে নির্বাচন আয়োজনের সমস্ত দায়িত্ব কমিশনের ওপর বর্তাবে।"

ড. ইউনূস বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

তবে নির্বাচন আয়োজনের পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। “আমরা মনে করি না, শুধু একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। এই ম্যান্ডেট আপনারাই আমাদের দিয়েছেন।"

তিনি জানান, সরকারের গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটি হলো নির্বাচন সংস্কার কমিশন। “নির্বাচন আয়োজনের জন্য এই কমিশনের সুপারিশমালা অত্যন্ত জরুরি। তাদের প্ল্যাটফর্মে যান এবং খোলামেলা মতামত দিন। নির্বাচনের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কারের কথা বলুন।"

নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে একটি চলমান ট্রেনের সঙ্গে তুলনা করে ড. ইউনূস বলেন, “নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটি আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে।"

তিনি আরও বলেন, “এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, তা নির্ভর করবে আমরা কত দ্রুত রেললাইনগুলো প্রস্তুত করতে পারি। আর সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত্যের মাধ্যমেই সম্ভব হবে।”

ড. ইউনূসের বক্তব্যে স্পষ্ট, নির্বাচন দ্রুত আয়োজনের পাশাপাশি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।