নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংক | গ্রাফিক:পদ্মা ট্রিবিউন

রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। নতুন ঋণ বিতরণ কমিয়ে আনলেও এসব ব্যাংকের পুরোনো ঋণ দফায় দফায় খেলাপি হচ্ছে। আবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব ব্যাংকে থাকা প্রভাবশালী অনেক ব্যবসায়ীর ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সরকারি চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৩ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। এ সময়ে পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।

ব্যাংক চারটির কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির ঋণ অনেক ক্ষেত্রে বাইরে পাচার হয়ে গেছে। আবার ব্যবসায় লোকসানের কারণেও কোনো কোনো ঋণ আদায় হচ্ছে না। এখন রাজনৈতিক কারণেও অনেক ঋণ নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়বে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে যেসব ঋণ বিতরণ হয়েছে, এই ঋণগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে। এতেই বাড়তে শুরু করেছে খেলাপি ঋণ। সামনে যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বেক্সিমকোতে কাবু সোনালী ব্যাংক
হল–মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আলোচিত সোনালী ব্যাংক নতুন ঋণ বিতরণে কয়েক বছর ধরেই সংযত। গ্রাহকের আমানত ব্যাংকটি সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে মুনাফা করছে। তবে আগে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার একটি অংশ সময়ে সময়ে খেলাপি হয়ে পড়ছে। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ বন্ধ করে দেয়। ফলে গত সেপ্টেম্বরে বেক্সিমকোর ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা ও জিএমজি এয়ারলাইনের ১৯১ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ে। একই সময়ে ওরিয়ন গ্রুপের ১১৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে যায়। এ ছাড়া লতিফ বাওয়ানি জুট মিলস, করিম জুট মিলস, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সোনালী আশ ইন্ডাস্ট্রিজ, চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ, প্যারাডাইস ইলেকট্রিকসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে তিন মাসে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। গত জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১৩ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আলী খান বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় কয়েকজন গ্রাহকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আমরা যোগাযোগ বাড়িয়ে এসব ঋণ নিয়মিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি সামনে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।’

জনতাকে ডুবাল বেক্সিমকো ও এস আলম
জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৬১ শতাংশই এখন খেলাপি। ব্যাংকটিকে ডুবিয়েছে বেক্সিমকো ও বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ। চলতি বছরের জুনে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। বেক্সিমকো গ্রুপে জনতা ব্যাংকের ঋণ ২৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, এর মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সমালোচিত অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, রতনপুর, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ আগে থেকেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এতে টান পড়েছে ব্যাংকটির তহবিলেও।

ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মুহ. ফজলুর রহমান অর্থসচিবের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন, দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো তহবিল না থাকায় এখন দৈনিক প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার করে চলছে ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এবারই প্রথম মুনাফার পরিবর্তে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে যাচ্ছে জনতা ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে লোকসানের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনতা ব্যাংক কীভাবে চলবে, সে বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা চেয়েছেন তিনি।

অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকও একই পথে
অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত জুনে ছিল ২১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যা বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। গত ৮ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে দেখলাম, আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হলেও এত দিন তা দেখানো হয়নি। আবার অনেক বড় গ্রাহকের ঋণও নতুন করে খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি নগদ টাকা আদায় ও ঋণ নিয়মিত করে তা আদায় করার।’

এদিকে গত জুনে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। বিদায়ী সরকারের মেয়াদে ব্যাংকটির অন্যতম প্রভাবশালী গ্রাহক স্কাই ক্যাপিটাল, বদর স্পিনিং ও ব্লু প্লানেট গ্রুপ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া স্টকিশ স্যুয়েটার, থার্মেক্স গ্রুপ ও জেএফকে ফ্যাশনের ঋণও গত প্রান্তিকে খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকটিতে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে এমডি নেই।