পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয় বলে উল্লেখ করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। বৈশ্বিক এ সংস্থা বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ-সংঘাত প্রতিরোধে কাজ করে এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে পরামর্শ দিয়ে থাকে। মারাত্মক ধরনের সংঘাতে আগাম সতর্কতা দিয়ে থাকে আইসিজি।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস | ফাইল ছবি |
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের সুযোগ আসে এই সরকারের সামনে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। এসব বিষয়ের নানা দিক এবং কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়ন হতে পারে, তার নানা দিক তুলে ধরেছে আইসিজে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার কর্মসূচি
জনগণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা পূরণ করা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতার ঘাটতিসহ নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, রয়েছে বাংলাদেশি সমাজের ভেতরে অব্যক্ত নানা অভিযোগ। আরও আছে বিবদমান রাজনীতি। এসব বিবেচনা করলে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার কর্মসূচির পূর্ণ বাস্তবায়ন খুব সম্ভবত কঠিন হবে।
এরপরও বাংলাদেশে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের বিরল সুযোগ। জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত নৃশংসতা এমন একটি মুহূর্ত তৈরি করেছে, যা ‘আর কখনো হওয়ার নয়’। ওই ঘটনা আরেকটি স্বৈরশাসকের আবির্ভাব রুখে দেওয়ার প্রত্যাশা তৈরির জন্য যথেষ্ট।
১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন, যাতে এগুলো তাঁর আদেশ প্রতিপালন করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে ক্ষমতাশালী করেছেন বা তাঁদের ওপরের কর্মকর্তাদের নানাভাবে দুর্বল করেছেন।
এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বর্তমান সরকারের প্রয়োজন আইন ও সংবিধান সংশোধন; নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। এ ছাড়া প্রয়োজন পুলিশ ও আমলাতন্ত্রে পরিবর্তন, যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য হলো, ‘আমরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো মেরামত না করি, তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে না।’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন | প্রতীকী ছবি |
এসব সংস্কার আনতে গত ১১ সেপ্টেম্বর ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। কমিশনগুলোর প্রধান করা হয়েছে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাবেক আমলাদের। কমিশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করবে। এগুলো হলো বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি ও সংবিধান।
কমিশনগুলোর সংস্কার কমিটি গত ১ অক্টোবর কাজ শুরু করেছে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। পরে অন্তর্বর্তী সরকার এ ছয় ক্ষেত্রে তাদের সংস্কার পরিকল্পনা শেষ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে এবং জনগণের মতামত নেবে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম অধিকার ও নারী বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আরও চারটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। তবে অন্তর্ভুক্তির ঘাটতি, বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি না থাকায় এসব কমিশন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
শাসনকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানো
সংস্কার কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন কাজটি হবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানো। ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন, যাতে এগুলো তাঁর আদেশ প্রতিপালন করে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজ কর্মী–সমর্থকদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে ক্ষমতাশালী করেছেন বা তাঁদের ওপরের কর্মকর্তাদের নানাভাবে দুর্বল করেছেন। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিচার বিভাগ, আমলা ও পুলিশের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাকে বদলি করেছে।
হাসিনার ক্ষমতার শেষ দশকে বিচারব্যবস্থা হাজার হাজার, কারও অনুমান লাখ লাখ মামলায় বাঁধা পড়ে। এসব মামলা হয় বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধেও। অভিযোগগুলো ছিল অতি তুচ্ছ বা প্রায়ই অস্তিত্বহীন প্রমাণের ভিত্তিতে। কিন্তু বিচারকেরা প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে মামলা খারিজ করতে নারাজ ছিলেন।
যাহোক, গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠানে এখনো রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অনেক কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সবাইকে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া বাস্তবসম্মতও নয়। সরকার চাইছে এই কর্মকর্তাদের সংস্কার কর্মসূচির অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিতে।
বিচার বিভাগ
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা কখনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। তবে হাসিনার সময় এ হস্তক্ষেপ উদ্বেগজনক মাত্রায় রূপ নেয়। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে তাঁর প্রশাসন আদালতকে ব্যবহার করে। ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতিকেও (এস কে সিনহা) পদত্যাগ করতে হয় চাপের মুখে। এর আগে তাঁর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জাতীয় সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে না বলে রায় দিয়েছিলেন। রায়ের পর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে চলে যান তিনি। পরে দৃশ্যত দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
দেশের প্রধান বিচারপতি চলে যাওয়ার পর হাসিনা স্পষ্ট বার্তা দেন যে বিচার বিভাগের যে কেউ তাঁকে অমান্য করলে তাঁর পরিণতি হবে শোচনীয়।
হাসিনার ক্ষমতার শেষ দশকে বিচারব্যবস্থা হাজার হাজার, কারও অনুমান লাখ লাখ মামলায় বাঁধা পড়ে। এসব মামলা হয় বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধেও। অভিযোগগুলো ছিল অতি তুচ্ছ বা প্রায়ই অস্তিত্বহীন প্রমাণের ভিত্তিতে। কিন্তু বিচারকেরা প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে মামলা খারিজ করতে নারাজ ছিলেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার অল্প কিছুদিন পর ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে সাবেক প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ সৈয়দ রেফাত আহমেদ। জুলাই ও আগস্টে বিক্ষোভকারী নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অন্যায্য মামলাগুলো তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোও ধাপে ধাপে প্রত্যাহার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘মানুষের আস্থার সংকট’ নিরসনে গত ২১ সেপ্টেম্বর বিচার বিভাগীয় সংস্কারের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর মূল পরিকল্পনা বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ দূর করে সুপ্রিম কোর্টের অধীন একটি আলাদা সচিবালয় গঠন করা।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে নিম্ন আদালতের তিন শতাধিক বিচারককে বদলি এবং পদোন্নতি দিয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক ক্রাইসিস গ্রুপকে বলেন, তাঁর সহকর্মীরা এরই মধ্যে এক নতুন স্বাধীনতা অনুভব করছেন। তাঁর কথায়, ‘সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে রাজনীতিকরণ ও চাপের ক্ষেত্রে। আমরা আগে যে রাজনীতিকরণ ও চাপের শিকার হয়েছি, এখন সেসবের কিছু ঘটছে না।’
প্রশাসন
প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার। আমলাতন্ত্র তথা প্রশাসনে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ফেরাতে এ সরকার বিচার বিভাগের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। আমলাতন্ত্রের আকার বিবেচনায় এ কাজ বিশাল। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিচ্ছে এবং এর আগে (আওয়ামী লীগ সরকার আমলে) যেসব সরকারি কর্মকর্তাকে জোর করে অবসরে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের ফেরত আনছে।
সরকার গত আগস্টে তিন ব্যাচের ৪০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার ঘোষণা করেছে। ৬৪ জেলা প্রশাসকের প্রায় সবারই স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। মধ্য আগস্টে সরকার ৮৫০ জনের বেশি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে; যাঁদের বেশির ভাগই হাসিনার পতনের পর পালিয়ে যান। তাঁদের স্থানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
এ প্রক্রিয়া খুব কমই মসৃণ ছিল। কেননা, পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এমন নিয়োগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন।
হাসিনার আমলে প্রশাসনকে শুধু রাজনীতিকরণই করা হয়নি; এখানে দক্ষতারও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কোটা ব্যবস্থার কারণে অনেক মেধাবী নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন; অন্যদিকে ছোট ও বৃহৎ আকারের দুর্নীতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে; হাসিনার আমলে এ পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে বিদ্যমান প্রশাসনকে কাজে লাগানো। এ প্রশাসন খুবই অদক্ষ। এখান থেকে কিছু পেতে বড় ধরনের সংস্কার চালাতে হবে।’
নিরাপত্তা খাত
যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে গিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা নিরাপত্তা খাত, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার। ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় এলে ক্রাইসিস গ্রুপ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল; এরপরও পুলিশ ছিল ‘রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার ও পৃষ্ঠপোষকতার (অন্যায় কাজকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দেওয়ার) একটি উৎস।’
হাসিনার পরবর্তী শাসনামলগুলোতে বিষয়টি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কর্মকর্তার ভাষায়, হাসিনা পুলিশকে তাঁর ‘আক্রমণকারী বাহিনী’তে পরিণত করেছিলেন।
বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগের সমর্থক, বিশেষ করে দলটির ‘গুন্ডা’ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে এ বাহিনীকে পূর্ণ করা হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাসিনা যে পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছিলেন, জুলাই–আগস্টের বিক্ষোভে সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে এ বিক্ষোভ শুরু হলেও পুলিশ তা নস্যাৎ করতে প্রাণঘাতী সহিংসতার আশ্রয় নেয়।
ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
হাসিনার আমলে প্রশাসনকে শুধু রাজনীতিকরণই করা হয়নি; এখানে দক্ষতারও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কোটা ব্যবস্থার কারণে অনেক মেধাবী নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন; অন্যদিকে ছোট ও বৃহৎ আকারের দুর্নীতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে; হাসিনার আমলে এ পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হয়েছে।
হাসিনার পতনের পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে কাজে যোগ দেননি। এ অবস্থায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সময়ে সেনাকর্মকর্তারা গ্রেপ্তারের আদেশ জারি ও তল্লাশি পরোয়ানা কার্যকর করা এবং বেআইনি সমাবেশ করতে না দেওয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষমতা দেওয়া হয়।
এ সিদ্ধান্তে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছে, ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড’ ঠেকাতে এর প্রয়োজন রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার জানে, জনগণ যদি মনে করে এ সরকার স্থিতিশীলতার মৌলিক স্তরটুকু নিশ্চিত করতে পারছে না, তবে তারা সমর্থন হারাবে। এটি বিরোধীদের দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ সৃষ্টির সুযোগ করে দেবে। এমন উদ্বেগও আছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে সহিংসতা উসকে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। এ ধরনের তৎপরতা সফল হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে এটি দুর্বল করার ঝুঁকি তৈরি করবে। এ প্রসঙ্গে এক ছাত্রনেতার মন্তব্য, ‘এটি গুরুত্ব দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়, কিন্তু তাঁদের একটা উদ্দেশ্য আছে।’
পুলিশ সদস্যরা ধীরে ধীরে কাজে ফিরেছেন। হাসিনার সময়ে নির্যাতন–নিপীড়নে জড়িত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যে বদলি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
যাহোক, পুলিশ বাহিনী সংস্কারে শুধু এসব পদক্ষেপই সম্ভবত যথেষ্ট নয়। পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা তলানিতে ঠেকেছে এবং তাদের নীতিনৈতিকতার মানও দুর্বল। আবার হাসিনার আমলে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন–পীড়নে ভূমিকা রাখায় আক্রমণের শিকার বা অভিযুক্ত হতে পারেন—এমন আশঙ্কায় আছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
পুলিশের মধ্যম সারির একজন কর্মকর্তা বলেন, এ বাহিনীর ভেতরে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যদের হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে পুলিশ সদস্যরা হতাশ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সদস্যদের মেরে রাস্তায় ঝোলানো হয়েছে। যেসব পুলিশ খুন হলেন, তাঁদের পক্ষে কে বিচার চেয়েছেন? একজনও নন।’
এই কর্মকর্তা বলেন, সরকারি নেতারা আগে থেকে যেভাবে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন, সেই ধারারও পরিবর্তন দরকার। তিনি বলেন, ‘সরকারকে বুঝতে হবে, আমরা রাজনৈতিক দলের কোনো ক্যাডার নই। তাঁদের নিজেদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করার অভ্যাসের কারণে আমাদের পেশাদারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
চলতি বছরের শেষ নাগাদ নবগঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত এ বাহিনীতে বড় ধরনের সংস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীতে সংস্কারকাজ চালানো আরও বেশি চ্যালেঞ্জের হতে পারে। এর আংশিক কারণ হতে পারে, তারা হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের অধীন, নয় এসব বাহিনীতে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের নির্ভরতা থাকায় ড. ইউনূস এ বাহিনীর সদস্যদের ঝামেলায় ফেলতে না–ও চাইতে পারেন।
সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বাহিনীর কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বাহিনীতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও রয়েছেন পুলিশ এবং আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আনসারের সদস্যরা। হাসিনার শাসনামলে সামরিক গোয়েন্দা শাখা ‘দ্য ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)’–এর বিরুদ্ধেও জোরপূর্বক গুম, ব্যাংক দখলসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
সেনাপ্রধান এসব সংস্থার প্রধানদের রদবদল করেছেন। সাবেক আমলের কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও নির্যাতনের ঘটনা কীভাবে রোধ করা যায়, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে এখন পর্যন্ত তেমন আলোচনা নেই।
সাংবিধানিক পরিবর্তন
অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। তা হলো গণতন্ত্র অক্ষুণ্ন রাখা এবং অন্য কোনো স্বৈরাচারকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ছিনতাই করা থেকে বিরত রাখতে সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা প্রয়োজন। তাই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেওয়া উচিত নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে।
ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, যেখানে সরকারের নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতির কাঁধে দেওয়া বিশাল দায়িত্ব এবং আইনপ্রণেতাদের নিজ দলের বাইরে গিয়ে ভোট দেওয়ায় বিধিনিষেধের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা যুক্তিসঙ্গতভাবে চালু ছিল। সাংবিধানিক এই বিধান শেখ হাসিনা ২০১১ সালে বাতিল করেন।
এখন সাংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্নে যে বিতর্কটি মূল হিসেবে সামনে এসেছে—বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন করা উচিত, নাকি সংবিধান পুনর্লিখন উচিত। সরকারের ভেতরের অনেকে ও বেশ কিছু প্রভাবশালী আইনবিদের মতে, সংবিধান পুনর্লিখন করা সময়সাপেক্ষ। এতে রাজনৈতিক বিভক্তির আশঙ্কা রয়েছে। এর জন্য সম্ভবত একটি গণপরিষদ লাগবে।
এমন উদ্বেগও আছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে সহিংসতা উসকে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। এ ধরনের তৎপরতা সফল হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে এটি দুর্বল করার ঝুঁকি তৈরি করবে।
তবে ছাত্রনেতাদের অনেকেই নতুন একটি সংবিধানের পক্ষে। তাঁদের যুক্তি হলো, বিদ্যমান সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত। ইতিমধ্যে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। এবং এই সংবিধান দেশের মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ছাত্রনেতাদের একজন বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই। যাতে আর কখনোই কোনো দল বা রাজনৈতিক আদর্শ দানব হয়ে উঠতে না পারে।’ তাঁর মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে এই ইচ্ছাপূরণের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কেননা, তাদের প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট এসেছে গণ–অভ্যুত্থান থেকে, ব্যালট থেকে নয়।
যে উপায়ই অবলম্বন করা হোক না কেন, কোনো কর্তৃপক্ষই নির্বাচনের পরবর্তী সময় পর্যন্ত সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে পারবে না। বিশেষ করে, এই অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই সংবিধান সম্মত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক নীতি
অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে মানুষের অসন্তোষ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। সরকার মনে করছে, কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর মতো মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় দীর্ঘ সময় দরকার। কিন্তু এই সরকার সম্ভবত তত দিন থাকতে পারবে না।
এই বাস্তবতায় সরকার মনে করছে, অর্থনৈতিক সংস্কারের চেয়ে রাজনৈতিক সংস্কার দ্রুতগতিতে করা সম্ভব। সেটা হলে বরং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ভালো হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
"আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই। যাতে আর কখনোই কোনো দল বা রাজনৈতিক আদর্শ দানব হয়ে উঠতে না পারে”
— বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা ।
দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে হাত না দিলেও অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির হালহকিকত বোঝার জন্য শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির কাজের মধ্যে আছে সাবেক সরকারের সই করা চুক্তি পর্যালোচনা করা। সেই সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান ছাড়াই সাবেক সরকার যেসব বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, সেগুলো খতিয়ে দেখা।
দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে হাত না দিলেও অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে আছে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো ও মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে আনা।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছিল। বাংলাদেশের কাছে ভারতের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর পাওনা ছিল এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের বেশি। জুলাইয়ের আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে রপ্তানির বৃহত্তম উৎস তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছিল। এই খাত কর্মসংস্থানের বড় জায়গা, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের।
বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক ধস এড়াতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থার কাছ থেকে কয়েক শ কোটি ডলারের সহায়তা পেয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা কি শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছি? অবশ্যই না। আমাদের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি; অর্থনীতিও ধসে পড়েনি; হতে পারত, কিন্তু হয়নি। এ বিষয়ে একধরনের উপলব্ধি থাকতে হবে যে বাংলাদেশ মন্দা এড়াতে পেরেছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্র কমিটি ও বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে টাস্কফোর্স গঠন করেছে। তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সরকার মূলত এই প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘তারা প্রতিবেদনে দেওয়ার পর সরকার কতটা গুরুত্বের সঙ্গে তা নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তখন বলা যাবে, সরকার দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে হাত দিতে চায় কি না। তার আগে সিদ্ধান্তে আসতে চাই না যে সরকার দীর্ঘ মেয়াদি সংস্কারে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না।
হাসিনার আমলে পরিসংখ্যান কারসাজি
শেখ হাসিনার জমানায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রশ্নাতীত, কিন্তু সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। হাসিনা সরকার যে তথ্য কারসাজি করত, এই বিষয় সবাই জানত, যাকে বলে উন্মুক্ত রহস্য। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপির অর্ধেক অব্যাখ্যাত, অর্থাৎ এর ব্যাখ্যা করা যায় না। কাঠামোগত উন্নয়ন বা আগের কোনো সংস্কারের কারণে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা বলা যায় না।
পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি হয়েছে, কিন্তু ঠিক কতটা হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। রপ্তানি তথ্যের গরমিলের কথাও বলেছে তারা।
বিচার ও জবাবদিহি
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়মিতভাবে অতীতের সব সহিংসতার জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছে। বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনার ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তির আওতায় ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়া হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
ড. ইউনূস ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকতে পারবে না। যদিও একেবারে শেষ অবধি হাসিনা সরকারের কট্টর সমর্থক ভারত এ অনুরোধে রাজি হবে কি না, সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
আপাতত ড. ইউনূস স্বাধীন তদন্ত পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছেন। গত আগস্টের শেষ দিকে অনুসন্ধানমূলক সফর শেষে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে বাংলাদেশে আট সদস্যরের একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। তারা গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনাগুলোর তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে। তদন্ত অনেকটাই শেষ হয়েছে। এখন সংগ্রহ করা তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
যেসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে, সেসব মোটেও বিতর্কিত নয়। তবে একবার তদন্ত শেষ হয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে সেটা নিয়ে এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হবে। কয়েকটি বিকল্পের একটি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) বিচার। অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা আইসিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরেকটি হতে পারে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মিশ্রণে একটি হাইব্রিড উদ্যোগ। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকর্তারা বলেছেন, যাঁরা তুলনামূলক কম অপরাধ করেছেন, তাঁদের জন্য সত্যানুসন্ধান ও পুনর্মিলন প্রক্রিয়া শুরু করা হতে পারে।
বিচার চাওয়ার সঠিক জায়গা কোনটা, তা নিয়ে ড. ইউনূস প্রশাসনের মধ্যেও তীব্র বিতর্ক রয়েছে। সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, বেশির ভাগ উপদেষ্টা মনে করেন, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাঁরা এ–ও মনে করেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইসিটির সামান্য হলেও বৈধতা রয়েছে। তাঁরা জানেন, এটা ক্যাঙারু কোর্ট। এখন হাসিনাকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে আইসিটিকে ব্যবহার করা হলে কিছু মানুষ খুশি হবেন। তবে সেই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
উচ্চ স্তরের অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত থাকবে, এমন ধারণা করা বেশ কঠিন। বিশেষ করে আইসিটিতে জামায়াত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় এ ঝুঁকি আরও প্রকট হয়েছে। দলটির কয়েকজন সাবেক নেতাকে এই আইসিটিতেই বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
একজন আইনবিশেষজ্ঞের মতে, মানুষ এখন আর এই প্রক্রিয়কে প্রতিশোধের বিচার হিসেবে দেখতে চায় না। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কিছু সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হতে পারে বিদেশি বিচারককে যুক্ত করা।
এর মধ্যেই স্থানীয় থানা-পুলিশ ও আদালতের মাধ্যমে একটি অগোছালো আইনি প্রক্রিয়া চালু করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে জনসাধারণের ফৌজদারি অভিযোগ গ্রহণ করার ক্ষত্রে পুলিশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এসব অভিযোগে কাদের নাম দেওয়া যেতে পারে, তার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ছাড়া গুরুতর অপরাধে পুলিশ পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারে। আর এই বিধান অতীতে বহুবার অপব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে।
হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক শ মানুষ এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ওই সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাও আছেন। জুলাই-আগস্টের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিচারক শুনানি শেষে আসামিদের রিমান্ডে কিংবা কারাগারে পাঠিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ শুধু হাসিনার বিরুদ্ধে দুই শতাধিক হত্যা কিংবা হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। তাঁর প্রশাসনের অনেক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাও একই অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন আইনবিশেষজ্ঞ বলেন, মামলায় নাম থাকা অনেকের সংশ্লিষ্ট ঘটনার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটা ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। মানুষ মনে করছে, যেকোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
ওই আইনজ্ঞ আরও বলেন, এসব মামলাকে ব্যাপকভাবে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত এসব আইনি অধিকার ও অনুশীলন বাতিল করার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন
অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। বিশেষ করে অনিয়মে ভরা বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এটা করা হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর চেয়েও বেশি কিছু। গত ১১ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূস নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিরই কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।
বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ আমলারা (জেলা প্রশাসক) নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।
কাজেই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এমন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তাদের নির্দলীয় ব্যক্তি হতে হবে।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংবিধানের ধারা বদলের পাশাপাশি এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন ‘সফলভাবে’ আয়োজন করতে পেরেছিলেন।
দেশে ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তার বিস্তৃত রাজনৈতিক সংস্কারের নীতি সফলভাবে এগিয়ে নিতে হবে।
কাজেই নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এমন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তাদের নির্দলীয় ব্যক্তি হতে হবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের পাঁচ সদস্যই পদত্যাগ করেন। তাঁরা বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের শর্ত পূরণ করতে পারছেন না তাঁরা। তাই একযোগে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত।
নির্বাচন কমিশন ছেড়ে যাওয়া কমিশনাররা বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্য রয়েছে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। আশা করা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবে।
একই সঙ্গে নির্বাচনী সংস্কার কমিশন সংস্থাটির ক্ষমতা ও দায়িত্বে পরিবর্তনের প্রস্তাব করবে। অন্তর্বর্তী সরকার ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করবে বলেও জানিয়েছে।
একটি মূল ইস্যু হলো এখনকার নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে কি না। সমালোচকদের মতে, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিষাক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এর বিপরীতে তাঁদের যুক্তি, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করা গেলে আরও বেশি রাজনৈতিক দলের জায়গা তৈরি হবে। একজন ছাত্রনেতা বলেন, ‘আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা দরকার, যা জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।’
আওয়ামী লীগ এখন কার্যত অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেছে। আর এটা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত বিএনপি এই পরিবর্তন মেনে নিতে বাধ্য হতে পারে।
তাঁদের একজন বলেন, ‘হ্যাঁ, বিএনপি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এই পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া দলটির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।’
আগামী নির্বাচনের জন্য সময়মতো আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা কীভাবে বিন্যাস করা যেতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে।