হারুন উর রশীদ স্বপন

নারায়ণগঞ্জে আপত্তির মুখে মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে লালন মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। শুক্রবার দুপুরে সদর উপজেলার মধ্য নরসিংহপুর এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের হুমকির মুখে লালন ভক্তদের আয়োজন করা ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। শুক্র ও শনিবার এই মেলা হওয়ার কথা ছিল।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় তারা এই অনুষ্ঠানের অনুমতি দেননি।’

অনুষ্ঠানের আয়োজক ফকির শাহজালাল এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হেফাজতের লোকজন আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মেলা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এটা খুবই দুঃখজনক।’

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহসভাপতি রাফিউর রাব্বি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের এই সিদ্ধান্ত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এখন যারা শক্তিশালী, তারা হুমকি দিয়ে যে কোনো আয়োজন বন্ধ করে দিতে পারবে।’
একতারা হাতে লালন ভক্ত | ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর আগে ৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। ফরিদপুরে লালন আনন্দধামে ভাঙচুর ও আগুন লাগানো হয়েছে। সিলেটে হজরত শাহপরানের মাজারে ওরশে হামলা, শাহজালাল মাজারে হামলার হুমকি এবং আরও কয়েকটি মাজারে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কোনো ক্ষেত্রেই হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো এসব এলাকায় অনুষ্ঠান বা মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার গোলাপ শাহ মাজারে হামলার চেষ্টাও হয়েছে।

মাজার-দরবারে হামলার প্রতিবাদে পীর, ফকির ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের ঢাকায় ‘গণপ্রতিরোধ যাত্রা।’ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা রক্ষার আহ্বান জানান | ফাইল ছবি

ফকির শাহজালাল বলেন, ‘আমি গত ১০ বছর ধরে এই লালন মেলার আয়োজন করছি। কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। এবারই প্রথম হেফাজতের চাপের কারণে মেলা বন্ধ হলো। কুষ্টিয়াসহ সারা দেশ থেকে লালন ভক্তরা মেলায় যোগ দিতে এসেছিলেন। অনেকে আমার বাসায় ছিলেন। তাদের খেতেও দেওয়া হয়নি। বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’
 
এবার মেলা উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো আয়োজক কর্তৃপক্ষ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় প্রতিবছর ২২-২৩ নভেম্বর এই মেলা হয়ে আসছে। কিন্তু এবার হেফাজতে ইসলাম অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে মেলা বন্ধের দাবি জানায় এবং মিছিল-সমাবেশ করে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক জানান, ফকির শাহজালাল মেলার অনুমতি চেয়ে দুই দিন আগে তার কাছে আসেন। তবে তার আগেই হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল আউয়াল তার সঙ্গে দেখা করে মেলা বন্ধের দাবি জানান। তারা অভিযোগ করেন, মেলায় অশ্লীলতা ও মাদক সেবন হয়।

বিভিন্ন সময়ে নারায়ণগঞ্জের মুক্তিধাম আশ্রমের আয়োজনে নরসিংহপুরে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান | ফাইল ছবি

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোনো খারাপ পরিস্থিতি হলে তা সামাল দেওয়ার মতো প্রস্তুতি ছিল না। তবে পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মেলা আয়োজন করা যেতে পারে।’
 
এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হলে তিনি বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা হওয়া উচিত। তবে বাউলদের এখানে গাঁজা সেবনসহ কিছু আপত্তিকর কাজ হয়, যা মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে। বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।’

এদিকে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুল আউয়াল বলেন, ‘মেলার বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও মাদক সেবনের অভিযোগ আগে থেকেই আছে। এলাকার তরুণদের এই মেলা নষ্ট করছে। আমরা সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এবার মেলা বন্ধ করেছি। ভবিষ্যতে এখানে আর কোনো বাউল মেলা হতে দেব না।’
 
গণপ্রতিরোধ যাত্রায় অংশ নেওয়া অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ড ছিল। তাতে লেখা ছিল—‘হামলাকারীকে লাল কার্ড, সরকারকে হলুদ কার্ড,’ ‘বহু মত বহু পথের বাংলাদেশ,’ ‘মাজার-দরবারের সুরক্ষা দিতে হবে,’ ‘ফ্যাসিবাদী হামলা রুখে দাঁড়াও,’ এবং ‘মব জাস্টিস চলবে না।’ এসব প্ল্যাকার্ডে সহিংসতা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে | ফাইল ছবি

তবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ফকির শাহজালাল বলেন, ‘আমরা লালনের গান গাই, বাউল সাধনা করি। কোনো ধরনের অশ্লীলতা বা মাদক সেবন এখানে হয় না। প্রশাসন হেফাজতের পেশিশক্তি ও আর্থিক শক্তির কাছে মাথা নত করেছে। আমাদের শক্তি না থাকায় আমাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমার কাছে আর এই দেশকে স্বাধীন মনে হয় না। তারা আমাকে নাস্তিক বলে হত্যার হুমকি দিয়েছে। অথচ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
 
নারায়ণগঞ্জের নরসিংহপুর গ্রামে ‘মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি’ প্রাঙ্গণ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

রাফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী লালন মেলা বন্ধের প্রতিবাদ জানাই। আমরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। শুরুতে তিনি নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে মেলা আয়োজনেই অনুমতি দিলেন না। পুলিশ দিয়ে বাউলদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতিমা বলেন, ‘সরকার হয়তো মনে করছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। যাদের শক্তি বেশি, সরকার যদি তাদের চাপ মেনে নেয়, সেটা দায়িত্বহীনতার পরিচয়।’
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লালন ভক্তরা এই মেলায় অংশ নিতে আসলেও শেষ পর্যন্ত সবাইকে ফিরে যেতে হয়েছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘কারো চাপের মুখে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা উচিত নয়। লালন মেলা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। প্রশাসনকে এই নতজানু নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’