প্রতিনিধি ঈশ্বরদী
বাংলাদেশ রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যপীঠ | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শিক্ষক–সংকটে ব্যাহত হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে শিক্ষা কার্যক্রম। স্কুলে ২১ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। বিভিন্ন বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান।
প্রমত্তা পদ্মা নদীর কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২৪ সালে। এ বিদ্যালয়ে একসময় পড়াশোনা করেছেন ভারতের বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ ও দেশের স্বনামধন্য কিডনি বিশেষজ্ঞ স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. কামরুল ইসলাম।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলাম বলেন, "এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২১টি শিক্ষক পদের মধ্যে মাত্র ৩ জন কর্মরত আছেন। প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি চলছে, তবে দীর্ঘদিন ধরে বেশিরভাগ বিভাগেই শিক্ষক শূন্যতা রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কোনো শিক্ষক ছুটিতে গেলে বা প্রশিক্ষণে গেলে সেই বিষয়ে পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়।"
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক সংকটের খবর পেয়ে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. কামরুল ইসলাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারজন অতিথি শিক্ষক নিযুক্ত করে তাঁদের বেতনও নিজে থেকেই পরিশোধ করছেন। এছাড়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় পাকশী কলেজের কয়েকজন শিক্ষক মাঝে-মধ্যে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে এসে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করেন। এইভাবে জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখার চেষ্টা করা হলেও স্কুলের চলার পথটি অত্যন্ত দুরবস্থার শিকার।
বিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তাটি ভেঙে খানাখন্দে ভরা, যা পায়ে হাঁটাও প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছে। রাস্তাটি ভাঙাচোরা থাকায় ছাত্রদের বাইসাইকেল প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টির সময় কাদা-পানিতে একাকার হয়ে যায় রাস্তাটি, যা শিক্ষার্থীদের পোশাক নোংরা করে দেয় এবং বাধ্য হয়ে তাদের অনেকেই বাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
বিদ্যাপীঠের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে ধারাবাহিক উন্নতির মধ্য দিয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের এসএসসি ফলাফল। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টির পাসের হার ছিল ৮৮ শতাংশ, যা ২০২১ সালে বেড়ে হয় ৯০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে ২০২২ সালে পাসের হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে আরও কমে হয় ৭৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২৪ সালে বিদ্যালয়টি সর্বোচ্চ সাফল্য অর্জন করে শতভাগ পাসের হার নিশ্চিত করে।
স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণির শিক্ষার্তী পপি আক্তার জানান, “রসায়নের শিক্ষক না থাকায় এই বিষয়ের প্রদর্শক মাঝেমধ্যে পাঠদান করান।”
নবম শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী দীপা জানান, “অর্থনীতির শিক্ষক না থাকায় ওই বিষয়ে পাঠদান হয় না।”
প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, “শতবর্ষী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব এখন ম্লান। অবনত অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়। একটাই দাবি—শিক্ষক সংকট দূর করতে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।”
প্রাক্তন ছাত্র এবং পাকশী রেলওয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা ইমরুল কায়েস পারভেজ বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সপ্তাহে দুই দিন তার কলেজের আইসিটি, বাংলা ও পদার্থবিদ্যার তিন শিক্ষক কলেজের ক্লাসের ফাঁকে স্কুলে গিয়ে পড়ান।
শিক্ষার্থী নিয়ে পাঠদান চলছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন 'প্রাক্তনীর' সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান মঞ্জু বলেন, “শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষ থেকে স্কুলের শিক্ষক সংকট সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” তিনি আরও বলেন, "আমরা আমাদের সকল প্রাক্তনীদের একত্রিত করে শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং বিদ্যালয়ের সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যও কাজ করছি। এছাড়া, ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা ও সুযোগ প্রদান করতে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করতে প্রস্তুত।"
প্রাক্তন ছাত্র এবং সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম সরদার বলেন, “আমরা যারা এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, তারা একত্রিত হয়ে শত বছরের ঐতিহ্য পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি। সরকারের কাছে আমাদের দাবি—শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সংকট নিরসন করা হোক। এছাড়াও, আমরা প্রাক্তনীর পক্ষ থেকে স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্য, এই প্রতিষ্ঠানটি যেন আগের মতোই শিক্ষার আলো ছড়াতে পারে এবং নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সেরা শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়।”
পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন, "এখনো এই স্কুলে শিক্ষক সংকট বিদ্যমান। তবে, একজন প্রাক্তন ছাত্রের ব্যক্তিগত উদ্যোগে চারজন অতিথি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং পাকশী রেলওয়ে কলেজ থেকে তিনজন শিক্ষক সপ্তাহে দুই দিন স্কুলে এসে পড়াশোনা করাচ্ছেন। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, শীঘ্রই এই সংকটের সমাধান হবে।"
এ উপজেলার প্রবীণ নাগরিক এবং প্রাক্তন অধ্যাপক উদয় নাথ লাহিড়ী বলেন, "শিক্ষক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। কয়েক বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া খুবই অবিশ্বাস্য। শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিভিন্ন দপ্তর রয়েছে, কিন্তু তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। বছরের পর বছর শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে, অথচ প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। এভাবে চলতে পারে না।"