প্রতিনিধি চট্টগ্রাম

বেইস টেক্সটাইল কারখানার ভেতরের দৃশ্য। ডাইং মেশিনের যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানা থেকে ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি চুরির অভিযোগে মামলা হয়েছে। এই কারখানা হলো চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায় অবস্থিত বেইস টেক্সটাইল লিমিটেড। বছর দেড়েক ধরে এই কারখানা বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রামের অন্যতম শিল্প এলাকার একটি কারখানা থেকে শতকোটি টাকার যন্ত্রপাতি চুরি নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চান্দগাঁও থানায় কারখানামালিকের পক্ষে ৬ নভেম্বর চুরির অভিযোগে মামলাটি করেন মীর মানজির আহসান নামের এক ব্যক্তি। মামলায় কারখানার বিদেশি যন্ত্রপাতি, গ্যাস জেনারেটর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ পণ্য চুরি হয় বলে অভিযোগ করা হয়।

কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর অস্থিতিশীলতার সুযোগে ছোটখাটো চুরি বাড়তে থাকে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেইস টেক্সটাইল লিমিটেডের পক্ষে চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। কারখানার ব্যবস্থাপক ফয়েজ আহমদ তাতে উল্লেখ করেন, কারখানার সামনে বখাটেদের আনাগোনা বেড়েছে। তারা কারখানার নিরাপত্তাকর্মী জহিরুল ইসলামকে মারধর করে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়। তখন চুরির অভিযোগ করা হয়নি। তবে গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের কয়েক দিন ধরে বড় ধরনের লুটপাট চালায় দুষ্কৃতকারীরা। ট্রাক নিয়ে এসে কারখানার যন্ত্রপাতি কেটে নেওয়া হয়। পুলিশ আসার খবর পেলে সরে যেত তারা। পুলিশ চলে যাওয়ার পর শুরু হতো লুটপাট। বন্ধ কারখানায় বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের বেঁধে এই লুটপাট চলেছে।

চুরির পর এভাবে পড়েছিল আসবাব | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মামলার আগে চুরির অভিযোগ পেয়ে  প্রতিবেদক কারখানা ঘুরে দেখেন। তাতে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচ। পাইপের টুকরা। পাকা মেঝে ভেঙে তুলে নেওয়া হয়েছে ছোট–মাঝারি আকারের যন্ত্রপাতি। জেনারেটরসহ বড় যন্ত্রপাতিও গ্যাসকাটার দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে। কাপড় রং করার ট্যাংক, যেগুলো কেটে নেওয়া যায়নি, শুধু সেগুলো পড়ে আছে শুধু। তবে যন্ত্রপাতি নেই। কারখানার পাশে প্রশাসনিক ভবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, টেলিভিশনসহ বৈদ্যুতিক পণ্য খুলে নেওয়া হয়েছে। ভাঙচুরও হয়েছে। তবে এসব পণ্য কখন কীভাবে বা কত দিনে চুরি হলো, তা নিশ্চিত হতে পারেনি।

জানতে চাইলে চাঁন্দগাও থানার চুরির মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক হৃদয় মাহমুদ লিটন বলেন, "শতকোটি টাকার চুরির অভিযোগে করা মামলার তদন্ত শুরু করেছি। যেসব যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম চুরি হয়েছে, তার তালিকা কারখানামালিকের কাছ থেকে চাওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে কখন চুরি হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কারা জড়িত ছিল।"

১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এই কারখানা দুই দশক আগে শীর্ষ পর্যায়ের রপ্তানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে ২০০৪–০৫ অর্থবছরে এই কারখানা থেকে রপ্তানি হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক। সে সময় কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল হাতে গোনা।

কারখানাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাহাদাত হোসেন। প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এস এম নুরুল হুদা চৌধুরী জাহাঙ্গীর। প্রায় এক দশক আগে দুই উদ্যোক্তা মারা গেলে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে আসে কারখানাটি। এরপর মালিকানা নিয়েও সমস্যা শুরু হয়। করোনার পর কারখানাটির রপ্তানি কমতে থাকে। শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয়। একপর্যায়ে ২০২২ সালের জুন মাসে তৈরি পোশাকের ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এক বছর পর বন্ধ করে দেওয়া হয় টেক্সটাইল ইউনিটও। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কারখানার নামে সর্বশেষ তুরস্কে একটি চালান রপ্তানি হয়েছিল।

এই দরজাটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে চোরের দল | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

কারখানার মালিকপক্ষ জানায়, কারখানা বন্ধের পর রাতের বেলায় সাতজন এবং দিনের বেলায় তিনজন নিরাপত্তাকর্মী পালা করে কারখানাটি পাহারা দিতেন। দুষ্কৃতকারীরা তাঁদের বেঁধে রেখে লুটপাট চালাত বলে কারখানার মালিকপক্ষ জানায়। কারখানার নামে ব্যাংক থেকে সব মিলিয়ে ২৩০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল, যা এখন সুদে–আসলে বেড়েছে।

জানতে চাইলে বেইস টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান শিবলী সোমবার বলেন, "অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কারখানায় ট্রাক নিয়ে এসে মালামাল নিয়ে গেছে দুষ্কৃতকারীরা। পুলিশ তদন্ত করলে আশপাশের কারখানার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশ চাইলে এখনো কারখানার চুরি হওয়া যন্ত্রপাতি উদ্ধার করতে পারে।"