নিজস্ব প্রতিবেদক
জেড আই খান পান্না | ফাইল ছবি |
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আদালতে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা হয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁও থানায় ১৭ অক্টোবর মামলাটি করা হয়। এই মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামি মোট ১৮০ জন। ৯৪ নম্বর নামটি জেড আই খান পান্নার।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী নানা আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো বন্ধ করার আদেশ চেয়ে গত ২৯ জুলাই আইনজীবীদের একটি দল হাইকোর্টে আবেদন করে। তাঁদের একজন ছিলেন জেড আই খান পান্না। শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ২৯ জুলাই নাগরিক উদ্যোগে গঠিত জাতীয় গণতদন্ত কমিশনের সদস্যও ছিলেন তিনি।
‘গণহত্যার বিচার চাই, গায়েবি মামলা-গ্রেপ্তার ও নির্যাতন বন্ধ কর’ শিরোনামে ২৯ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে একটি মানববন্ধন করা হয়। ‘আইনজীবী সমাজ’–এর ব্যানারে আয়োজিত সেই মানববন্ধনে ছিলেন জেড আই খান পান্না।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন জেড আই খান পান্না। সংবিধান নতুন করে লেখার যে কথা বলা হচ্ছে, তারও তীব্র সমালোচনা করছিলেন তিনি। জেড আই খান পান্না গণমাধ্যমে বলেছেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তার ঘোষণাপত্র পাল্টানো যাবে না। যদি করে, তাহলে যুদ্ধ না, মহাযুদ্ধ হবে।
জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে করা মামলায় গত ১৯ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহাদুল ইসলাম নামের একজনকে গুলি ও মারধর করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার প্রায় তিন মাস পর ১৭ অক্টোবর মামলাটি করেন আহাদুলের বাবা মো. বাকের।
মামলাটিতে আসামি হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বর্তমান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নাম রয়েছে।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯ জুলাই খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাজারের পশ্চিমে শুক্কুর আলী গার্মেন্টস মোড়ে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নেন বাদী মো. বাকেরের ছেলে মো. আহাদুল ইসলাম। এ সময় পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন এবং ১৪-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা দেশি অস্ত্রশস্ত্রসহ ককটেল ও সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটান এবং আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য হত্যার উদ্দেশ্যেই এ গুলি চালানো হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। সেখানে আহাদুল ইসলাম বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। সন্ত্রাসীরা তাঁকে পরে লাঠিপেটা করেন। আহাদুলকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিক, পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়।
মামলার বিষয়ে জেড আই খান পান্না বলেন, "এটা কোনো না কোনো প্রভাবশালীর ইন্ধনেই হয়েছে, তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। অথচ আমি কোটা আন্দোলনকারীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলাম। যে স্থানের কথা বলা হয়েছে, সেই মেরাদিয়ায় আমি কখনো গেছি বলেও তো মনে হয় না।"
জেড আই খান পান্না জানান, তিনি আজ সোমবার হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করবেন।
মামলার বাদী মো. বাকেরের মুঠোফোন নম্বর এজাহারে নেই। সাধারণত এজাহারে বাদীর মুঠোফোন নম্বর উল্লেখ করা হয়। তাঁর মুঠোফোন নম্বর পুলিশের কাছে চাওয়া হয়েছিল। তবে পুলিশ বলেছে, "তাদের কাছে নম্বর নেই।"
কোনো ধরনের প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই এই মামলা নেওয়া হয়েছে বলে জানান খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. দাউদ হোসেন। তিনি রোববার রাতে বলেন, বাদীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আসামিদের নাম-ঠিকানা সঠিক আছে কি না, সেটি তদন্ত করে দেখা হয়েছে। তবে আসামিরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না, সেটি প্রাথমিকভাবে তদন্ত করা হয়নি। তিনি বলেন, তদন্তের পর কেউ জড়িত না থাকলে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হবে।
‘মানুষের আস্থাও নষ্ট হবে’
জেড আই খান পান্নাকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করাকে ‘অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও নিন্দনীয়’ বলেছে মানবাধিকার সংগঠন আসক। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে গতকাল বলা হয়, মানবাধিকার বিষয়ে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট-সংশ্লিষ্ট জেড আই খান পান্নার আলোচনা, মতামত ও বক্তব্যসংক্রান্ত তাঁর কোনো ভূমিকার কারণে কোনো পক্ষের অসন্তুষ্টি থেকে এ ধরনের মামলা দায়ের হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হওয়া হত্যাচেষ্টা মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বিভিন্ন সংগঠন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে মামলা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই এসব মামলার আসামির তালিকা তৈরি পেছনে রয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। মামলাগুলোতে ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের মাধ্যমে যাঁরা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলাকে বিস্ময়কর ও ভীতিকর হিসেবে উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, জেড আই খান পান্না একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এবং সব সময় মানুষের অধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে থেকেছেন। তিনি বলেন, এখন অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, পাইকারি হারে মামলা হচ্ছে। সেখানে শত শত ও হাজার মানুষের নাম জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এর মাধ্যমে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের পথ খোলা হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করা আর হবে না, যেটা এই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। শুধু তা–ই নয়, এতে এই সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাও নষ্ট হবে।