মহসিন কবির
দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কার করার পর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনগুলো প্রস্তাব পেশ করবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিশিষ্টজনরা এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছে।
সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে তৃতীয় দফায় রাজনৈতিক দলগুলো সঙ্গে বৈঠক করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তৃতীয় দফার আলোচনার প্রথম পর্বে বিএনপি-জামায়াতসহ আটটি দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো ১৬ বছরের অসংখ্য অন্যায়, অনিয়ম ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরে নানা খাতে সংস্কারের দাবি জানিয়েছে। টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর দেশ শাসন করা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে নানা ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে।
দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক মতৈক্য গড়ে সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে তারপরে নির্বাচনের কথা ভাবছেন বলে তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
রাজনৈতিক দলগুলোর স্পষ্ট করে দেওয়া ‘আগে সংস্কার ও পরে তারা নির্বাচনে যেতে চায়’ সেই বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ কথা বলেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা।
উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেছেন, "সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন প্রশ্নে পদ্ধতি প্রক্রিয়ায়ও সংস্কার সাধন প্রয়োজন হবে অর্থাৎ গণপরিষদ গঠন তথা গণভোটের মাধ্যমে হতে পারে, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে। বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর এবং এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত বা তর্ক-বিতর্কের অবকাশ থাকা বা রাখা সমীচীন হবে না।"
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংস্কার গ্রহণযোগ্য হবে না। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে বলে আসছেন, নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংস্কার গ্রহণযোগ্য হবে না। এ জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করে আসছেন তারা।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, "আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্বাচন–সম্পর্কিত। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।"
মির্জা ফখরুল বলেছেন, "আমি মাস, দিন, কাল নিয়ে কথা বলব না। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাঁদের ১ নম্বর অগ্রাধিকার। বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তাঁরা দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাঁদেরও দাবি।"
জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বল্প মেয়াদে নির্বাচনমুখী সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। গণপরিষদ গঠন ও সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাবকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মন্তব্য করে বিদ্যমান সংবিধানের মধ্য থেকেই এই সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচনের প্রস্তুতি, "নির্বাচন কমিশন গঠন ও সংস্কার একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হবে, যাতে দ্রুত একটা নির্বাচন করা যায়।"
সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
মান্না বলেন, "সবার সঙ্গে কথা বলেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো করতে হবে। আর সবার সঙ্গে আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার হবে। কমিশনের প্রধান নিজের মতো নিজে প্রস্তাব দিবেন, তা হবে না। সংস্কারে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না তা নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেয়া হবে।"
তিনি বলেন, "অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার প্রশ্নে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। যে সময়টা লাগবে তা দিতে হবে। আমরা কী জানতাম এত বড় একটা অভ্যুত্থান হবে? আমরা জানতাম, দেড় মাস পুলিশ থাকবে না? পুলিশ সংস্কার ছাড়া কীভাবে নির্বাচন করবেন? নির্বাচন কমিশন সংস্কার মানে কী? পুরো নির্বাচন ব্যবস্থারই সংস্কার। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সময় দিতে হবে। তবে নির্বাচন আয়োজন ও সংস্কারের জন্য এই সরকারকে যৌক্তিক সময়ের বেশি নেবেন না। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধান উপদেষ্টা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিয়ে চলে যাবেন। অন্যদের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে রাখবেন না।"
নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা এবং শিক্ষাসহ সার্বিক বিষয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের ১০ দফায় ৮১টি প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
দলটি বিদ্যমান সংসদীয় আসন পদ্ধতির পরিবর্তে ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধিত্বশীল পদ্ধতিতে সংসদ নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে। ৯ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে দলটির প্রস্তাবনা তুলে ধরেন জামায়াতের নায়েব আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো তাহের।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, "প্রথম রোডম্যাপটি হবে সংস্কারের, আর দ্বিতীয়টি নির্বাচনের। সফল সংস্কারের পরই নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে বলে আমরা মনে করি।"
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনোদিনই সম্ভব নয়। এটা ইউটোপিয়ান (কাল্পনিক)। কিন্তু, সবার মতামতের ভিত্তিতে একটা কনসেনসাস(মতৈক্য) যদি দাঁড় করানো যায়, সেটিই হবে কাঙ্ক্ষিত। তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষের সম্মতির শাসন যদি প্রতিষ্ঠিত না হয় তাহলে যত ক্ষেত্রে যত সংস্কারই করা হোক না কেন, কোনোটাই টেকসই হবে না।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানকে সংবিধানের ভেতর থেকে বৈধতা আদায় করতে হয় না; বরং গণ-অভ্যুত্থান খোদ নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থার বৈধতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।