মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুছবি: এএফপি | ফাইল ছবি |
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছিল কিছুদিন আগেই। এবার দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে আসার কথা মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, সবকিছু ঠিকমতো এগোলে আগামী অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই মুইজ্জু দিল্লি আসতে পারেন। সফরের সম্ভাব্য তারিখ ৭ থেকে ৯ অক্টোবর। অবশ্য দুই দেশের সুবিধা অনুযায়ী সেই তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
প্রবল ভারতবিরোধিতা ও ‘আউট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের ঢেউয়ে চেপে গত বছরের নভেম্বর মাসের নির্বাচনে মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হন। প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি সে দেশে অবস্থানকারী ৮৮ জন ভারতীয় সেনাকে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রথানুযায়ী মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সব সময় ভারতকেই বেছে নেন। মুইজ্জু সেই প্রথা ভেঙে প্রথম সফরে যান তুরস্ক। তারপর চীন। ভূরাজনীতিতে দুই দেশের অবস্থানই ভারতের বিপক্ষে। চীন সফরের সময় কারও নাম না করে তিনি এই মন্তব্যও করেছিলেন, ‘আমরা আয়তনের দিক থেকে ছোট দেশ হতে পারি, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে কেউ আমাদের চোখ রাঙাবে।’
শুধু এই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাক্ষাদ্বীপ সফরে যাওয়ায় মালদ্বীপের দুই মন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চূড়ান্ত অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন। সেই মন্তব্য ঘিরে প্রবল সমালোচনা শুরু হয়। ভারতীয় পর্যটকেরা যাতে মালদ্বীপ সফরে না যান সে জন্য শুরু হয় ব্যাপক প্রচার। সেই প্রচারে ব্যাহত হয় মালদ্বীপের পর্যটনশিল্প। এই পরিস্থিতিতে কিছু ব্যবস্থা নেয় মুইজ্জু সরকার। দুই প্রতিমন্ত্রী মালশা শরিফ ও মরিয়ম শিউনাকে প্রথমে বরখাস্ত করা হয়।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারত দফায় দফায় সেনা অপসারণ করে নেয় মে মাসের মধ্যে। মালদ্বীপকে দেওয়া দুটি হেলিকপ্টার ও একটি ডর্নিয়ার বিমান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে সেনারা ছিলেন, তাঁদের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় অসামরিক প্রযুক্তিবিদদের। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুও তিক্ততার অবসানের কূটনৈতিক ইঙ্গিত দিতে থাকেন। মে মাসের ১০ তারিখে শেষ দফার সেনা প্রত্যাহারের পর ভারতে আসেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির। জুন মাসে তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথম দিল্লি আসেন মুইজ্জু। সেই সফরের ঠিক আগে বরখাস্তকৃত দুই প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর আগস্ট মাসে মালদ্বীপ সফরে যান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেখানে ‘প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে’ মালদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের উল্লেখ করে জয়শঙ্কর বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠই শুধু নয়, প্রতিবেশী প্রথম নীতি অনুযায়ী মালদ্বীপের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন ভারতের অগ্রাধিকার। বোঝা যাচ্ছিল, তিক্ততার অবসান ঘটে সম্পর্ক এগোতে শুরু করেছে। বরফও গলছে দ্রুত।
তার
আরও একটা প্রতিফলন ঘটেছে জাতিসংঘের আসরে যোগ দিতে মুইজ্জুর যুক্তরাষ্ট্র
সফরে। সে দেশের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন,
প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অসম্মান করে তাঁর দুই প্রতিমন্ত্রী ভুল করেছিলেন।
মালদ্বীপের সংবাদমাধ্যম ‘আধাধু’ মুইজ্জুর বয়ানে জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট
আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘ওই ধরনের কথাবার্তা কারও বিরুদ্ধে কারও বলা উচিত নয়।
আমি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ওইভাবে কাউকে অপমান করা আমি মানব না।
তা তিনি নেতা বা সাধারণ মানুষ যেই হোন। প্রত্যেক মানুষেরই সুনাম থাকে।’
প্রিন্সটন
বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনা সভায় তাঁর সরকারের ভারতবিরোধিতা ও ‘আউট ইন্ডিয়া’
প্রচারণা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মুইজ্জু বলেন, ‘কখনো আমরা কোনো দেশের
বিরুদ্ধাচরণ করিনি। ওটা ইন্ডিয়া আউট ছিল না। বিদেশি সেনাদের থাকা দেশের
মানুষ মেনে নিচ্ছিল না। সে নিয়ে একটা বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল।’
সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বরফ গলার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের। সাউথ ব্লকের এক সূত্র সেই বৈঠককে ‘চেনাজানা পর্ব’ অভিহিত করার পাশাপাশি জানিয়েছে, আলোচনা ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’। ভারতের প্রতিবেশী নীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে জয়শঙ্করও একই কথা অন্য এক অনুষ্ঠানে বলেছেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, আজকের দুনিয়ায় হাত ধরাধরি করে চলাই দস্তুর। তাতেই সবার মঙ্গল।
ভারতের নীতিনির্ধারকদের একাংশের ধারণা, মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ ক্রমেই গলবে। গলবে পারস্পরিক স্বার্থেই। দরকার দুই দেশের স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সতর্ক পদচারণ।