প্রতিনিধি রাজশাহী: রাজশাহীতে সরকারি সম্পত্তি জালিয়াতির অভিযোগে মহানগর বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান ওরফে মিনু। আদালত ওই সম্পত্তিতে ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন। এই জমি নগরের বোয়ালিয়া মৌজায় অবস্থিত। এটি রাজশাহী নগরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ভেতরে পড়েছে, মোট জমির পরিমাণ ৬ কাঠা।
মামলায় বিবাদী করা হয়েছে রাজশাহী মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা ও ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে। তাঁদের দাবি, জমিটি চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সভাপতি রেভা. সুনীল মানখিন ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর বিক্রয় কবলা দলিলমূলে তাঁদের হস্তান্তর করেছেন। নজরুল হুদার বাড়ি নগরের রাজারহাতা এলাকায়। আর মিজানুর রহমানের বাড়ি নগরের হড়গ্রাম পূর্বপাড়া মহল্লায়। রেভা. সুনীল মানখিনের ঠিকানা দেওয়া রয়েছে ৩৯১, নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জমিটিতে দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম চলেছে। তারপর হাফিজুল ইসলাম সোহেল নামের একজন ব্যবসায়ী ভাড়া নিয়েছিলেন। হাফিজুল ইসলাম জানান, ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম বন্ধের পর থেকে তিনি ওই সম্পত্তি ভাড়া নেন। চার্চ অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভাড়ার টাকা নিত। ২০১০ সালে চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই সম্পত্তি তাঁর কাছে বিক্রির প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
একপর্যায়ে ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে হাফিজুল জানতে পারেন, জমিটি চার্চ অব বাংলাদেশের নয়। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মি. হেমিলটন নামের এক ব্যক্তির নামে রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে তাঁর কোনো ওয়ারিশ না থাকায় এটি সরকারি সম্পত্তি হয়ে গেছে। তার পর থেকে তিনি আদালতের মাধ্যমে ভাড়া প্রদান করে আসছেন। চলতি মাসের ভাড়াও পরিশোধ করা হয়েছে জানিয়ে হাফিজুল বলেন, এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট দেশে সরকার পতনের পরের দিন ভবনের নিচতলায় তাঁর অফিস ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। দোতলায় ছিল তাঁর পরিবার। জোর করে তাঁদের উচ্ছেদ করে নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমান ওই জমির দখল নেন। ৭ আগস্ট এই জমিতে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়।
ওই জমিতে গিয়ে টাঙানো সাইনবোর্ডটি দেখা যায়। এতে লেখা রয়েছে ‘জমিদাতা চার্চ অব বাংলাদেশ। খরিদ, ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক নজরুল হুদা দিং। মৌজা বোয়ালিয়া, জেএল নম্বর ০৯। দলিল নম্বর ৯০১৬। প্রস্তাবিত খতিয়ান নম্বর ১৪২৬৯। হোল্ডিং নম্বর ১৪৫৩৩। দাগ নম্বর ১৯৪৩,১৯৪৪ ও ১৯৬৩। ১১৩৫–এর দশমিক ০৯৯০ একর। বাংলা মাপে ৬ কাঠা।’
বিষয়টি জানতে পেরে ৮ আগস্ট মিজানুর রহমান এ বিষয়ে রাজশাহীর সদর সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন। মামলা নম্বর ২০২ / ২০২৪। মামলায় বিএনপির নেতা নজরুল হুদা, ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, রেভা. সুনীল মানখিনকে বিবাদী করা হয়েছে। এ ছাড়া মোকাবিলা বিবাদী করা হয়েছে রাজশাহী জেলা প্রশাসককেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান মিনু বলেন, তিনি মেয়র ও সংসদ সদস্য ছিলেন। জনস্বার্থে তিনি মামলাটি করেছেন।
আদালতের বিচারক মামলার বিবাদী নজরুল হুদা ও মিজানুর রহমানকে কেন নালিশি সম্পত্তিতে বহুতল ভবন নির্মাণ বা জবরদখল থেকে বিরত থাকার আদেশ প্রদান করা হবে না, এই মর্মে কারণ দর্শনো নোটিশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার শুনানি না হওয়া পর্যন্ত পক্ষগণকে ওই সম্পত্তিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ প্রদান করেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির নেতা নজরুল হুদা গত বৃহস্পতিবার বলেন, এই সম্পত্তি তাঁরা চার্চ অব বাংলাদেশের কাছ থেকে বৈধভাবে কিনেছেন। এখানে তাঁর নির্মাণকাজে বাধা দিতে আসার কারও এখতিয়ার নেই। সেদিন তিনি বলেছিলেন, আদালতের কোনো নোটিশ তিনি পাননি।
নগরের বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, নালিশি সম্পত্তির মালিক হেমিলটন সাহেব ওরফে হেমিলটন সাহেব। তাঁর নামেই এসএ, আরএস ও সিএস খতিয়ান। ২০২০ সালে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এই জমির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণের ক্ষতি পূরণের টাকা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ওই বছর ২৫ আগস্ট মি. হেমিলটনের মহিষবাথানের ঠিকানায় চিঠি দেওয়া হয়। এরপরের বছরই চার্চ অব বাংলাদেশ আরএস রেকর্ডে প্রজার নাম ভুল রয়েছে বলে সংশোধনের জন্য আবেদন করে। আবেদনে বলা হয়, হেমিলটন ওই সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য চার্চ অব বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। খতিয়ানে ভুলবশত তাঁর নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যা করণিক ভুল। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার আবুল হায়াত চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সংশোধন করে নামজারি খতিয়ান সৃজন করেন।
মিজানুর রহমানের আইনজীবী জমশেদের ভাষ্য, তিনটি রেকর্ড যাঁর নামে রয়েছে, করণিক ভুল বলে এসি ল্যান্ড তা সংশোধন করতে পারেন না। তা একমাত্র দেওয়ানি আদালত অথবা কোর্টের এখতিয়ারভুক্ত। কোনোভাবেই এসি ল্যান্ড করতে পারেন না।
এ ছাড়া ২৯ আগস্ট মিজানুর রহমান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবনটি পুরাকীর্তি ঘোষণা, বাধ্যতামূলক অধিগ্রহণ, সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি আবেদন করেছেন। ১ সেপ্টেম্বর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদা সুলতানার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এই জমিতে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল ভবন পরিদর্শন করে।