সতর্ক থাকতে হবে, চক্রান্তের মধ্যে যেন পথ না হারাই: মির্জা ফখরুল

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘গণতন্ত্রের সংগ্রামে, বীর শহীদের স্মরণে সভায়’ বক্তব্য দেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে সবাইকে নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু সতর্ক থাকতে হবে। চক্রান্তের মধ্য দিয়ে আমাদের কেউ যেন বিপথে নিয়ে যেতে না পারে। আমরা যেন কোনোমতেই পথ না হারাই।’

আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘গণতন্ত্রের সংগ্রামে, বীর শহীদের স্মরণে সভায়’ এ কথা বলেন মির্জা ফখরুল। শনিবার বিকেলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিএনপি।

আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ও বিগত ১৭ বছর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আজ শহীদ মিনারে স্মরণ সভা করেছে দলটি।

পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচিকে আজ বেলা সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বেলা আড়াইটা থেকেই দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করেই শহীদ মিনারের এই কর্মসূচিতে অংশ নেন হাজারো নেতা-কর্মী। অনবরত বৃষ্টির কারণে অনেকে ছাতা হাতে নিয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়ান। অনেকে বৃষ্টিতে ভিজেই কর্মসূচিতে অংশ নেন।

এই কর্মসূচিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজন, নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও অংশ নেন। সভা থেকে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও অংশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিবাদী গান পরিবেশন করা হয়েছে। বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাসাসের আয়োজনে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ছাত্র-জনতার ওপর চালানো জুলুম–নিপীড়নের চিত্র মূকাভিনয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নিহত অনেকের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের অনেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভায় যোগ দেন। ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘হয়তো স্বাধীন হয়েছি। তবে এখনো চতুর্দিকে নাগিনীরা ছাড়ছে নিশ্বাস। তারা বিভিন্নভাবে চক্রান্ত করে আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য। ঐক্য নিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর লড়াই করেছি, সেই ঐক্যকে অটুট রাখতে হবে। কোনোমতেই তাদের চক্রান্তে পা দেওয়া যাবে না।’

সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি
বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৬ বছর ধরে যেসব মামলা হয়েছে, তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘১৬ বছরে ধরে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি, আমরা অত্যন্ত নির্যাতিত হয়েছি, নিপীড়িত হয়েছি। আমাদের প্রায় সাত শ ভাইবোন গুম হয়েছেন। সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪৫ হাজার মামলা হয়েছে। ১৭ বছরে ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অবিলম্বে এবং অতি দ্রুত সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভায় যোগ দেন। ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
১৬ বছর ধরে এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ ও ভাতা দেওয়ার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল। দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। জনগণ প্রত্যাশা করে, এই সরকার এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ (সবার জন্য সমান সুযোগ) তৈরি করে দেবে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে এমন একটি জায়গায় আনবে, যেখানে সত্যিকার অর্থেই একটি অর্থবহ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।

গোপালগঞ্জে হামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, তারা এখনো হায়েনার মতো লুকিয়ে আছে। যেকোনো সময় আক্রমণ করবে। সেই আক্রমণকে প্রতিহত করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
 
ভুক্তভোগীরা বিচার চান
স্মরণসভায় এসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন বলেন, সাঁজোয়া যান থেকে তাঁর ছেলেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য এখনো নিতে পারছেন না। ইয়ামিনের মতো আর কারও যাতে এই অবস্থা না হয়। আর কোনো মা–বাবাকে যাতে এমন কষ্টের মুখোমুখি হতে না হয়।

শহীদ মিনারে আয়োজিত সভায় পুলিশের গুলিতে দুই চোখ হারানো টাঙ্গাইলের হিমেলের মা বলেন, ‘আমার ছেলে আন্দোলনে গিয়ে দুটি চোখ হারাইছে। আমরা খুবই গরিব। দেখার কোনো লোক নাই। সরকারের কাছে আবেদন, সে যাতে একটা চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখতে পারে।’ আন্দোলনে নিহত লিটন চন্দ্র শীলের মা রুবী শীল শেখ হাসিনার বিচার চেয়ে আকুতি জানান।
 
গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা ছবি হাতে যোগ দেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্মরণসভায়। ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন
 
টাঙ্গাইলের নিহত মো. ইমনের ছোট ভাই মো. সুজন বলেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে ইমন বড় ছিলেন। তাঁর বড় ভাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাদের বাবা মারা যান। বড় ভাই পরিবারের সবকিছু দেখাশোনা করতেন। এখন তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ভাইয়ের হত্যার বিচার বাংলার জমিনে দেখতে চান বলে জানান সুজন।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিনের সঞ্চালনায় স্মরণ সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, ১২ দলীয় জোটের নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর ও জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। আরও বক্তব্য দেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ও দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন প্রমুখ।