ছেলে রমজানের ছবি হাতে নিয়ে কথা বলছিলেন বাবা নজরুল ইসলাম ও মা রোজুফা বেগম। গতকাল সিংড়া উপজেলার সাঐল হাজিপাড়ার নিজ বাড়িতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি নাটোর: ‘দায়িত্ববান বলতে যা বোঝায়, তা ছিল আমার ছেলি রমজান আলী। আমাকে চাপ না দিয়া মানুষের বাড়িত কাজ করি মেট্রিক পাস করিছে। অল্প বয়সে সৌদি আরব গেছে। এর দুই বছর পর দেশে আসি আইএ পাস করি আবার ডিগ্রিতে ভর্তি হইছে। এর মধ্যে ঢাকার বাইপাইলে গিয়ে মাছের আড়তে কাজ নিসে। বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকাও জমা করছিল। কিন্তু হঠাৎ আন্দোলন শুরু হয়। আর আমার ছেলি দেশের কথা ভাবি মিছিল–মিটিংয়ে যোগ দিত। গত ৫ আগস্ট সকালে বাইপাইলে মিছিলের মধ্যিই সে গুলি খাইল, আর দুপুরে মারা গেল এনাম মেডিকেলে।’
একটানা কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত রমজান আলীর (৩০) বাবা নজরুল ইসলাম। গতকাল শুক্রবার সকালে নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাঐল হাজিপাড়ার নিজ বাড়িতে বসে এ কথা বলেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পুরোটা সময় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন রমজান। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন বেলা ১১টার পরপর ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে নজরুল বলেন, মিছিলে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ছোড়া একটি গুলি রমজানের বুকের বাঁ পাশে এসে লাগে। পরে সেটি বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা তাঁকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা দেড়টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
তিন ছেলে ও তিন মেয়ের সংসারে রমজানকে সবচেয়ে দায়িত্ববান সন্তান বলে মনে করতেন তাঁর মা–বাবা। এমন অবলম্বন হারিয়ে প্রায় দিশাহারা অবস্থায় আছেন এই বৃদ্ধ দম্পতি। আশঙ্কা আর আক্ষেপের সুরে রমজানের বাবা এবার বলে উঠলেন, ‘এখন আমার আর ওর মায়ের দায়িত্ব তো কেউ নিচ্ছে না। সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হইছে। এক ছেলে সৌদি আরবে গিয়ে দালালের পাল্লায় পড়ে আটকা পড়িছে। মেজ ছেলে স্থানীয় বাজারে কাজ করে। আর রমজান সবার ছোট ছিল।’
আন্দোলন সফল হওয়ার এক মাস পেরুলেও একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কেউ এই শহীদ পরিবারের খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ করেন রমজানের মা–বাবা। পরিবারের অন্য সদস্যরা বলেন, অর্থের অভাবে চাঁদা তুলে রমজানের জন্য দোয়ার অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তবে নজরুল ইসলাম গত সপ্তাহে ছেলের মৃত্যুসনদ সংগ্রহের জন্য ঢাকায় গিয়ে সরকারের এক উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
এখন প্রায় সারা দিন ছেলে রমজানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মা রোজুফা বেগম। বাড়িতে কেউ এলেই ছেলের প্রসঙ্গ তোলেন। আর তাঁর স্মৃতির গল্প বলে বলে আফসোস করেন। বলেন, ‘সর্বশেষ গত রোজার ঈদে রমজান বাড়িতে আইছিল। ওরে নিজের হাতে খাওয়াইছিলাম। কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসতে পারেনি। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকত। গন্ডগোলের মধ্যেও ফোন করিছিল। বলিছিল, “মা তোমাদের জন্য আমার যেমন দায়িত্ব আছে, দেশের জন্যও তেমনি দায়িত্ব আছে। আন্দোলন শেষ হলেই বাড়ি ফিরব।” ছেলে আমার বাড়ি ফিরিছে। কিন্তু লাশ হয়ে।’