রাজশাহীতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ব্যবহৃত জমি কেনা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ খণ্ডন করতে জমি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘চার্চ অব বাংলাদেশের’ সংবাদ সম্মেলন। শনিবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি রাজশাহী:  রাজশাহীতে ব্রিটিশ কাউন্সিলের ব্যবহৃত জমি কেনা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ খণ্ডন করতে আজ শনিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে জমি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’। এতে জমি কেনাবেচার প্রায় পৌনে ছয় কোটি টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারার অভিযোগ ওঠে। আয়োজকেরা সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

জমিটি রাজশাহী নগরের মালোপাড়া এলাকায়। প্রায় ৬ কাঠা জমির ওপর দীর্ঘদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সম্প্রতি জমিটি বিএনপির দুই নেতা কিনেছেন মর্মে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দুই নেতা হলেন মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদা ও নগরের রাজপাড়া থানা বিএনপির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান।

জমির দাম ধরা হয় ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন দুই ক্রেতা। বাকি আছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু দলিলে জমির মোট মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জমি বিক্রেতা ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’ বলছে, দলিলে যে দাম দেখানো হয়েছে, ওই দামেই জমি বিক্রি করা হয়েছে এবং পুরো টাকা চার্চের তহবিলে জমা করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, যদি দুই ক্রেতা ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্য ধরে সাড়ে ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করে থাকেন, তাহলে তহবিলে জমা করা ৭৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বাদ দিয়ে ৫ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এই টাকা কি দুই পক্ষ ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন? আয়োজকেরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

নগরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ জমি আইনবহির্ভূতভাবে রেকর্ড সংশোধন করে চার্চ অব বাংলাদেশের নামে করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আবার চার্চ অব বাংলাদেশ পরে সেই জমি পানির দরে বিক্রি করেছে। এ নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর ‘সরকারি সম্পত্তি জালিয়াতির অভিযোগে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। আজ বিকেলে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চার্চ অব বাংলাদেশ। বিবদমান ওই জমিতে অবস্থিত ভবনেই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন চার্চ অব বাংলাদেশ পরিচালিত রাজশাহীর খ্রিষ্টিয়ান মিশন হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল। সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে জানতে চান, জমিটি বিক্রি করা হয়েছে কত টাকায়? জবাবে তিনি বলেন, ‘৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় জমি বিক্রি করা হয়েছে। পুরো টাকাই চার্চ অব বাংলাদেশের তহবিলে জমা করা হয়েছে।’

অথচ ২৪ সেপ্টেম্বর জমির দুই ক্রেতার একজন মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, জমির দাম ধরা হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ছয় কোটি টাকা তাঁরা দুজন পরিশোধ করেছেন। রাজস্ব ফাঁকি দিতে দলিলে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জমি কিনতে সাড়ে ছয় কোটি টাকা দুজনে কীভাবে ম্যানেজ করেন, সেটিও তিনি সেদিন বলেছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, জমির দুই ক্রেতার পরিশোধ করা সাড়ে ৬ কোটি টাকার মধ্যে বাকি ৫ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা কোথায় গেল? জবাবে সংবাদ সম্মেলনে প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল দাবি করেন, ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি একটি পয়সাও তাঁরা নেননি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জমির ক্রেতা নগরের রাজপাড়া থানা বিএনপির আহ্বায়ক মিজানুর রহমানও। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনিও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

নগরের মালোপাড়া এলাকায় বোয়ালিয়া মৌজায় এই জমির পরিমাণ ছয় কাঠা। এর মধ্যে সাড়ে চার কাঠা দলিল করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ও মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল হুদার নামে। শহরের প্রাণকেন্দ্রের মহামূল্যবান এই সাড়ে ৪ কাঠা জমি কেন মাত্র ৭৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, সেই প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেননি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজকেরা।

এই জমি সিএস এসএস ও এসএ খতিয়ানে জমির মালিকের স্থানে লেখা আছে, ‘মিস্টার হেমিলটন সাহেব, সাং মহিষবাথান’। আরএস খতিয়ানে জমির মালিক হিসেবে লেখা আছে, ‘মিস্টার হেলিটন সাহেব, সাং মহিষবাথান।’ ২০২০ সালে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য এই জমির কিছু অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ওই বছর ২৫ আগস্ট মিস্টার হেমিলটন সাহেবের মহিষবাথানের ঠিকানায় চিঠি ইস্যু করা হয়।

পরের বছরই ‘চার্চ অব বাংলাদেশ’ আরএস রেকর্ডে প্রজার নাম ভুল রয়েছে বলে সংশোধনের জন্য আবেদন করা হয়। তারা দাবি করে, হেমিলটন চার্চ অব বাংলাদেশের একজন তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। করণিকের ভুলে জমিটি তাঁর নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। তারা জমিটি চার্চ অব বাংলাদেশের নামে রেকর্ড করে দেওয়ার আবেদন করে। এরপর ২০২১ সালের ১৫ মার্চ বড়কুঠি ভূমি অফিসের তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত জমিটির রেকর্ড সংশোধন করে দেন। জমিটির মালিকানা পেয়ে যায় চার্চ অব বাংলাদেশ। পরে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চার্চ অব বাংলাদেশের পক্ষে সভাপতি রেভা. সুনীল মানখিন দুই বিএনপি নেতার কাছে ওই জমি বিক্রি করে দেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর জমিটি দখলে নেন দুই নেতা।

এই জমি নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি হয়েছে দাবি করে রাজশাহীর সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনু সম্প্রতি আদালতে মামলা করেন। তিনি দাবি করেছেন, ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে এই জমি ব্রিটিশ নাগরিক হেমিলটন সাহেবের নামে রেকর্ড রয়েছে। তিনি এখন নেই। তাঁর কোনো ওয়ারিশও নেই। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এ জমি এখন সরকারের। কোনোভাবেই চার্চ অব বাংলাদেশ মালিকানা পায় না। তারা এ জমি বিক্রিও করতে পারে না।

মিজানুর রহমান মিনুর আইনজীবী জমশেদ আলী বলেন, আদালতের আদেশ ছাড়া কোনো এসিল্যান্ড এভাবে সংশোধন করতে পারেন না।

সংবাদ সম্মেলনে দেশের এই আইন নিয়েও সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। কিন্তু আয়োজকেরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। পরপর তিনটি খতিয়ানে করণিকের ভুলে কীভাবে জমির মালিক হিসেবে হেমিলটনের নাম থাকল, সেই প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেননি প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল।

রাজশাহী নগরের চন্ডীপুর এলাকায় আরেকটি মূল্যবান জমি মাত্র ৬৪ লাখ টাকায় ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের কাছে বিক্রি করেছে চার্চ অব বাংলাদেশ। এই জমিটিও কেন একই ব্যক্তির কাছে পানির দরে বিক্রি করা হয়েছে, সেই প্রশ্নেরও সদুত্তর দেননি প্রদীপ চাঁদ মণ্ডল। সাংবাদিকদের বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই দ্রুত সংবাদ সম্মেলনটি শেষ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে চার্চ অব বাংলাদেশের জমিজমাসংক্রান্ত সেক্রেটারি প্রকৃতি বিশ্বাস, সিনড ট্রেজারার বিনিময় বিশ্বাস, রাজশাহী ডিনারির (ডিন) অঞ্চল প্রধান রেভারেন্ড মিকায়েল সরেন, রেভারেন্ড সমুয়েল হেমব্রম, রেভারেন্ড তপন মণ্ডল, রাজশাহী ডিনারির প্রপার্টি ম্যানেজার ইফ্রইম হেমব্রম, সম্পাদক রাজু মার্ডি, মহিষবাথান চার্চের সম্পাদক রিপন কিস্কু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।