সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা ভাগাভাগি করে বালু তুলছেন। গত মঙ্গলবার বগুড়ার ধুনট উপজেলার শহড়াবাড়ী খেয়াঘাট এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি বগুড়া: ১৬ বছর বগুড়ার ধুনটে যমুনা নদীর বালু লুটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতারা। বৈধ বালুমহাল থেকে বালু তোলার পাশাপাশি আইন লঙ্ঘন করে তাঁরা ইজারা এলাকার বাইরে থেকে বালু তোলেন।
গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর বিএনপি ও সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতারা লুটপাটে ভাগ বসিয়েছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আদর্শিক বিভেদ থাকলেও বালু লুটপাটে তাঁরা মিলেমিশে একাকার।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ধুনটের ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের চৌবেড় মৌজার ৩৯ একর এলাকাকে বালুমহাল ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল ৫৭ লাখ টাকায় বালুমহালের ইজারা পায় উপজেলা যুবলীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক বেলাল হোসেনের মালিকানাধীন ‘মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স।’
তবে বেলাল দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ইজারা এলাকার বাইরে ধুনটের শহরাবাড়ি নৌঘাট থেকে ভূতবাড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় বালু তোলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সালেহ (স্বপন), ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য হজরত আলীসহ আরও কয়েকজন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর বেলালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকা সাম্রাজ্যে ভাগ বসান বিএনপি ও যুবদলের নেতারা।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না।
সরেজমিন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভান্ডারবাড়ি বালুমহাল ইজারা নিলেও যুবলীগ নেতা বেলাল এত দিন নদীর ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ২০ থেকে ২৫টি ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত বালু তুলছিলেন। বালুমহাল চৌবেড় মৌজার বাইরে বৈশাখীর চর, বথুয়ারভিটা, রাধানগর, পুকুরিয়া, ভূতবাড়ি পয়েন্ট থেকে বালু তুলতে দেখা যায়। এসব বালু বাল্কহেডে শহড়াবাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ স্পার এলাকায় স্তূপ করার পর ট্রাকে বিভিন্ন এলাকায় যায়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বালুমহালসহ অবৈধ বালু উত্তোলনের সাম্রাজ্য সমঝোতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে নেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা।
এর মধ্যে যুবলীগের নেতা বেলাল হোসেন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক রাসেদুজ্জমান উজ্জ্বল, উপজেলা বিএনপির সদস্য বেলাল হোসেন ও ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম ১৫ শতাংশ করে মোট ৬০ শতাংশ ভাগ করে নিয়েছেন। বাকি ৪০ শতাংশের ২০ শতাংশ ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান এবং বিএনপির সমর্থক কবির ও হালিম, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম, ইউনিয়ন যুবদলের নেতা বিপ্লব, ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা শহিদুল ইসলামের মধ্যে ২০ শতাংশ ভাগাভাগি হয়েছে। শহড়াবাড়ি ঘাটে ছাত্রলীগের নেতা আবু সালেহের বালু পয়েন্টটি ৫ আগস্টের পর যুবদল নেতা রাসেদুজ্জামান পরিচালনা করছেন।
বালুমহাল ভাগাভাগির বিষয়টি স্বীকার করেছেন যুবলীগের নেতা বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বালু ব্যবসার ভাগাভাগি হয়েছে। লিখিত চুক্তিপত্র অনুযায়ী এখন ব্যবসার ১৫ ভাগ তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে। বাকিটুকু উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক রাসেদুজ্জমান, উপজেলা বিএনপির সদস্য বেলাল হোসেন, ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসানসহ কয়েকজনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে। তবে ইজারা এলাকার বাইরে বালু উত্তোলনের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
ভান্ডারবাড়ি বালুমহাল ইজারা নিলেও যমুনা নদীর ১৫ কিলোমিটার এলাকায় ২০ থেকে ২৫টি ড্রেজার বসিয়ে দিনরাত বালু তোলা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার ধুনট উপজেলার শহড়াবাড়ী খেয়াঘাট এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
উপজেলা বিএনপির সদস্য বেলাল হোসেন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সাত্তার নামে সিরাজগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর ছেড়ে দেওয়া ৩০ শতাংশ দলীয় ছেলেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিয়েছি। আমার নিজের কোনো বালু ব্যবসা নেই।’
যুবদলের নেতা রাসেদুজ্জমান ৬ শতাংশ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে গোসাইবাড়ি ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম দাবি করেন, তাঁর কোনো বালু ব্যবসা নেই। যমুনায় বালু ব্যবসার সঙ্গে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশিক খান বলেন, চৌবেড় মৌজার যমুনার তলদেশের ৩৯ একর আয়তন থেকে ৫৫ লাখ ঘনফুট বালু তোলার ইজারা পেয়েছেন বেলাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। ইজারাদারের ব্যবসায় কেউ অংশীদার আছে কি না, তা জানা নেই। তবে অন্য কাউকে উপ–ইজারা দেওয়ার বিধান নেই। এমন হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইজারা এলাকার বাইরে বালু তোলার বিষয়ে ইউএনও বলেন, ৫ তারিখের পর অভিযোগ পেয়ে সেনাবাহিনীসহ এলাকায় গিয়ে তাঁদের সতর্ক করেছেন। এরপরও অব্যাহত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হুমকিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধসহ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা হতে সর্বনিম্ন এক কিলোমিটারের মধ্যে থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না। বালু বা মাটি উত্তোলনের সময় ড্রেজিংয়ের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হতে পারে, এমন আশঙ্কা থাকলে এসব ক্ষেত্রেও বালু তোলা অবৈধ।
যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ স্পার ঝুঁকিতে ফেলে বালুর পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার ধুনট উপজেলার শহড়াবাড়ী খেয়াঘাট এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
সরেজমিন দেখা যায়, ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের চৌবেড় মৌজা থেকে ৫৫ লাখ ঘনফুট বালু তোলার ইজারা দেওয়া হলেও শহড়াবাড়ি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে ভূতবাড়ি পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকায় অবৈধভাবে বালু তোলা হচ্ছে। শহড়াবাড়ি, শিমুলবাড়ি, বথুয়ারভিটা, বৈশাখীর চর, ভান্ডারবাড়ি, ভূতবাড়ি, বানিয়াজান, কয়াগাড়ি মৌজায় নির্বাচার বালু তোলা হচ্ছে। বানিয়াজান এলাকায় বালু তোলা হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) স্পার কাছাকাছি এলাকা থেকে। হুমকির মুখে পাউবোর বাঁধ। এসব বালু শহড়াবাড়ি ঘাট এলাকার ১২টি পয়েন্টে ফেলা হচ্ছে।
পাউবো সূত্র জানায়, নদীভাঙন রোধে ২০০৩ সালে প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০০ মিটার দৈর্ঘ্য আড়াআড়িভাবে শহড়াবাড়ি ও বানিয়াজান নামে দুটি স্পার নির্মাণ করে পাউবো। ২০১৭ সালে ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ভূতবাড়ি থেকে শহড়াবাড়ি গ্রাম পর্যন্ত আরও তিন কিলোমিটার অংশে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক দিয়ে ডান তীর সংরক্ষণ করা হয়। নদী থেকে অবাধে বালু তোলায় শহড়াবাড়ি, শিমুলবাড়ি, পুকুরিয়া, ভূতবাড়ি ও ভান্ডারবাড়ি এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।
পাউবোর বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, স্পার, বাঁধ বা অন্য যেকোনো স্থাপনা হুমকিতে ফেলে কেউ বালু তুললে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয় পাউবো। সরেজমিন পরিদর্শনের পর স্থাপনা হুমকিতে ফেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে বালু উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।