তোফাজ্জলকে মেরে ফেলার আগে খাবার খেতে দেওয়া হয়েছিল (ওপরে)। গণপিটুনির পর ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ (নিচে) | ছবি: সংগৃহীত |
নাজিয়া আফরিন: গেল কয়েক দিনে ‘মব মেন্টালিটি’, ‘মব জাস্টিস’, ‘মব রুল’—এই শব্দবন্ধগুলো ঘুরেফিরে বারবার চোখের সামনে আসছে। ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গণপিটুনি’র শিকার হয়ে মারা গেছেন দুজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনির পর মারা গেছেন শামীম মোল্লা। তিনি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। বিচারবর্হিভূত এই হত্যাকাণ্ডের পর ‘মব’ বিষয়টি নিয়ে আবারও জোর আলোচনা–সমালোচনা চলছে।
দিনকয়েক আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের মৃত্যু নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢের আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইল, এ নিয়ে অনেকটা বিভক্তই হয়ে পড়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। মৃত্যুর পাঁচ দিন আগেই কন্যাসন্তানের জনক হওয়া মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন।
তবে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০২০ সালে রাজধানীর বাড্ডায় একটি স্কুলে মেয়ের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগম ওরফে রেনু। ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে পড়লে আশপাশ থেকে কয়েক শ মানুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। ‘উত্তেজিত জনতা’র রোষে বিভিন্ন মতাদর্শের, রাজনীতির, ধর্মের ও ধর্মপন্থার মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতির এমন খবর পত্রিকার পাতাজুড়ে পাওয়া যায় প্রায়ই।
জনতার মানসিকতা, জনতার ন্যায় বা জনতার শাসন নিয়ে কথা বলার আগে প্রথমে মনে হয় এখনকার সময়ের ‘জনতা’ কেমন, তা বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। ১৯৮৭ সালে ‘ভার্চ্যুয়াল কমিউনিটি’ ধারণার প্রবক্তা মার্কিন তাত্ত্বিক হাওয়ার্ড রাইনগোল্ড ২০০২ সালে আরেকটি ধারণার সঙ্গে বিশ্বের পরিচয় ঘটান, যা হলো ‘স্মার্ট মব’ বা ‘সুচতুর জনতা’। ২০০২ সালে প্রকাশিত বই ‘স্মার্ট মবস: দ্য নেক্সট সোশ্যাল রেভল্যুশন’ বইয়ে তিনি বলেন, ‘সেসব মানুষকে নিয়েই “সুচতুর জনতা” গড়ে উঠেছে, যারা পরস্পরের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছাড়াই সমন্বিতভাবে কাজ করতে সক্ষম...কারণ তারা এমন সব যন্ত্র বহন করে, যেগুলোর একই সঙ্গে যোগাযোগ এবং কম্পিউটারের মতো কাজ করার দক্ষতা রয়েছে।’ কাজেই ‘কম্পিউটারের মতো কাজ করার’ সামর্থ্যযুক্ত স্মার্টফোন পকেটে নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই ‘সুচতুর জনতা’র যেকোনো সামষ্টিক তৎপরতা কিংবা পদক্ষেপ গৃহীত হয় প্রযুক্তির শক্তিতে। একইভাবে তাদের সামষ্টিক জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়াও প্রবলভাবে প্রযুক্তিনির্ভর।
বস্তুত আমরা সবাই-ই এখন এমন এক ‘ইনফরমেশন সোসাইটি’ বা তথ্যসমাজের বাসিন্দা, যেখানে তথ্য আহরণ, নির্মাণ, বিতরণ ও ব্যবহারের ভিত্তিতেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ডিজিটাল নাগরিকদের জীবনধারায় তাই আরেকটি শব্দ এখন ব্যাপক গুরুত্ববাহী—সেই শব্দটি হলো ‘অ্যালগরিদম’। এই প্রায় ঐশ্বরিক গাণিতিক পরিভাষায় কি আসলেই আমাদের ডিজিটাল অস্তিত্বের রূপরেখা আঁকা হচ্ছে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আমাদের ব্যক্তিগতকৃত অভিজ্ঞতার শতভাগ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু এই ব্যক্তিগতকরণ প্রক্রিয়া আসলে কী? এটি কোনো একক ব্যবহারকারীর জন্য স্বতন্ত্র নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে তা আপনাকে কোনো না কোনো গোষ্ঠীতে শ্রেণিবদ্ধ করছে। এ ক্ষেত্রে যে প্রোফাইলিং প্রযুক্তির ব্যবহারে আপনাকে স্বকীয়তার অনুভূতি প্রদান করা হচ্ছে, তা পুরোপুরি সম্ভাব্যতার ওপর নির্ভর করে। এই প্রযুক্তি ব্যক্তিসত্তার বোধ সৃষ্টি বা শনাক্ত করতে কোনোভাবেই সক্ষম নয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে এটি ব্যক্তিসত্তার বোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। একজন ব্যবহারকারীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিডে ক্রমাগত যা প্রদর্শিত হবে, একসময় নিজের অজান্তেই তিনি তা চাইতে শুরু করবেন। তিনি আসলেই কী করতে চাইতেন, তা একসময় গৌণ হয়ে পড়বে এবং সবাই যা করছে বলে মনে হবে, তারই অংশ হওয়ার আকুলতা বোধ করতে শুরু করবেন।
আজকের স্মার্ট মব বা সুচতুর জনতার মানসিকতা, তৎপরতা শাসনের ক্ষেত্রে তাই নানা স্তরে নানা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতার সুলুকসন্ধান করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে পারস্পরিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই দ্রুত সংগঠিত হওয়া এবং সামষ্টিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিতে এই স্মার্ট মব পারঙ্গম। যেকোনো বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিতেও তাঁরা দ্রুত ভূমিকা রাখতে পারেন।
কানাডীয় শিক্ষক ও তাত্ত্বিক রোনাল্ড জে ডিবার্ট তাঁর প্রবন্ধ ‘দ্য রোড টু ডিজিটাল আনফ্রিডম: থ্রি পেইনফুল ট্রুথস অ্যাবাউট সোশ্যাল মিডিয়া’তে বলেছেন কমপালশন লুপের কথা। মূলত অনলাইন গেমে একধরনের তাড়নার চক্র তৈরি করা হয়, যাতে ব্যবহারকারী আটকে থাকেন। ডিবার্টের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়ও ব্যাপক হারে ‘কমপালশন লুপ’ বা তাড়নার চক্র তৈরি করা হয়। এসব চক্র কাজ করে পরিবর্তনশীল মাত্রায় প্রণোদনার মাধ্যমে। ব্যবহারকারীকে অপ্রত্যাশিতভাবে পুরস্কৃত করা হয়। এই আপাত-অপ্রত্যাশিত পুরস্কার মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতা বা সামাজিক বাধ্যবাধকতার অনুভূতিকেও উসকে দেওয়া হয়। অনেকটা মাদকের মতো আসক্তি সৃষ্টিতে মস্তিষ্কে একই ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে যেন প্রভাবিত করে, এমন উপায় অবলম্বন করা হয়। এসব উপায়ের একটি হচ্ছে ‘মোরাল আউটরেজ’ বা ‘নৈতিক ক্ষোভ’কে কাজে লাগানোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। নৈতিক মূল্যবোধের অবমাননাকারীদের প্রতি যৌক্তিক রাগ, ঘৃণা ও হতাশাই হলো নৈতিক ক্ষোভ। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে গবেষণায় দেখেছেন, নৈতিক ক্ষোভ প্রকাশকারী একটি শব্দ একটি টুইটের রিটুইট করার মাত্রা ১৭ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক সময় ব্যবহারকারীরা একই ধরনের চরমপন্থী, ষড়যন্ত্রমূলক ‘কনটেন্ট’—যাকে বাংলায় বলা যায় আধেয়—বারবার দেখতে থাকেন। আর এটাকে বলা হয় ‘র্যাবিট হোল ইফেক্ট’। কাজেই অ্যালগরিদম পদ্ধতিগতভাবে চরমপন্থী ও ভ্রান্তিমূলক কনটেন্টের প্রচার চালিয়ে যাবে, সেই তোয়াক্কা না করে যেকোনো অশুভ উদ্দেশ্যে এর বীজ বপন করা হচ্ছে। আর এভাবেই এই আপাত বিনা মূল্যের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোয় ব্যবহারকারীরা বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমিক হয়ে উঠছেন। তাঁদের মনোযোগ ও অংশগ্রহণের পন্যায়ন ঘটিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ছে বড় বড় করপোরেশন। ‘সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারির পুঁজিবাদের বিকাশের এই সময়ে ব্যক্তিগত তথ্যই সবচেয়ে বড় পুঁজি।
প্রযুক্তি প্রশাসনবিষয়ক গবেষক ক্যারেন ইয়াং এই তথ্য চালিত আচরণগত পরিবর্তনের কৌশলের নাম দিয়েছেন ‘হাইপার নাজিং’। এটি ব্যবহারকারীর তথ্যগত পছন্দের পটভূমি এমন গতিশীলভাবে সাজায়, যার মাধ্যমে পূর্বনির্ধারিত উপায়ে তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করা সম্ভব। সেই সঙ্গে ডিজিটাল স্পেসে জ্ঞানগত অসমতাও প্রবল থাকে। ফলে আপনার আর্থিক সামর্থ্য ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি কীভাবে বিচরণ করবেন। একটি দামি স্মার্টফোনে অনেক বেশি ফিচার আর অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা থাকবে। বিবিধ ভাষাজ্ঞানের অধিকারী হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন স্তরের ‘টেক্সট’ বা ‘কনটেন্ট’-এর অর্থোদ্ধার সহজতর হবে। নতুবা অনুকরণ বা সহজ কথায় অ্যালগরিদমের দাস হয়ে পড়া মুহূর্তের মামলা।
আজকের স্মার্ট মব বা সুচতুর জনতার মানসিকতা, তৎপরতা শাসনের ক্ষেত্রে তাই নানা স্তরে নানা গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতার সুলুকসন্ধান করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেকোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে পারস্পরিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই দ্রুত সংগঠিত হওয়া এবং সামষ্টিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিতে এই স্মার্ট মব পারঙ্গম। যেকোনো বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিতেও তাঁরা দ্রুত ভূমিকা রাখতে পারেন। গোল্ডরাইনের মতে, তাঁদের মুঠোফোনটাই হয়ে উঠতে পারে দুনিয়া বদলানোর রিমোট কন্ট্রোল। কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা আসলেই কি তাঁদের হাতে? নাকি অ্যালগরিদমের ফেরে পড়ে অনেক ক্ষেত্রেই পাল্টে যাচ্ছে সমীকরণ?