শরতে টানা বর্ষণ, ৭৮ ঘণ্টায় ঝরেছে ৩৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি

তিনদিন ধরে বরিশালে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বটতলা এলাকায় রোববার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বরিশাল: শরতের অবিরাম বর্ষণে বরিশালের জনজীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষণ আর ঝোড়ো আবহাওয়ায় থমকে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা। নগরের প্রায় সব রাস্তাঘাটে হাঁটুসমান পানি জমে আছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আজ রোববার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি ঝরেছে ৩৪৪ মিলিমিটার। অথচ আবহাওয়া বিভাগের বৃষ্টিপাতের গড়পঞ্জি হিসাবে পুরো সেপ্টেম্বরে এখানে বৃষ্টি ঝরার কথা ২৫৯ মিলিমিটার। অর্থাৎ পুরো মাসের বৃষ্টির স্বাভাবিক হিসাব ছাপিয়ে মাত্র ৭৮ ঘণ্টায় ৮৬ মিলিমিটার অতিরিক্ত বৃষ্টি ঝরেছে। এই অতিবৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে নদ-নদীতে উঁচু জোয়ার। এতে বৃষ্টির পানি নদীতে নিষ্কাশিত হতে পারছে না। তেমনি নদীর উঁচু জোয়ারের পানিও নর্দমা দিয়ে এসে পড়ছে নগরে। এতে বরিশাল নগরে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।

বরিশাল আবহাওয়া দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বশির উদ্দীন বলেন, গত ৭৮ ঘণ্টায় অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা আরও বেশ কিছু সময় ধরে থাকতে পারে।

রোববার নগরের নবগ্রাম রোড, আমির কুটির, অক্সফোর্ড মিশন রোড, কলেজ অ্যাভিনিউ, গোরস্থান রোড, সার্কুলার রোড, ভাটিখানাসহ আরও বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা দেখা যায়, সেগুলো জলাবদ্ধ। অক্সফোর্ড মিশন এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা পানিবন্দী। নিচু ও কাঁচা ঘরে রান্না পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।
কলেজ অ্যাভিনিউ এলাকার বাসিন্দা অলোক চক্রবর্তী বলেন, ‘ঘরে-বাইরে সব জায়গায় পানি আর পানি। আমাদের জীবন এখন এতটা দুর্বিষহ যে বলে বোঝাতে পারব না।’

আমির কুটির এলাকার বাসিন্দা কুট্টি বেগম বললেন, ‘মাইনসের বাড়ি কাজ কইরা সংসার চলে। কিন্তু তিন দিন ধইরা বৃষ্টিতে ঘরদুয়ার তলাইন্না। আইজ আর কাজে যাওনের অবস্থা নাই। কী অইবে কইতে পারি না।’

নগরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলেই সদর সড়ক, গোরস্থান রোড, কালু শাহ সড়ক, বটতলা, বাংলাবাজার, কলেজ অ্যাভিনিউ, ফকিরবাড়ি সড়ক, আমির কুটির, অক্সফোর্ড মিশন রোড, গোরস্থান রোড, ভাটিখানা, আমানতগঞ্জ, মল্লিকবাড়ি সড়ক, ব্রাউন কম্পাউন্ড, মহিলা কলেজ ও এর আশপাশ এবং নগরের পূর্বাংশের বিশাল এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তখন ঘর থেকে বের হওয়াই মুশকিল হয়ে যায়। এ ছাড়া রাস্তায় গাড়িও তেমন চলাচল করে না। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালতে চলাচলে খুবই সমস্যা হয়।

এদিকে গত তিন দিন নগরের রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ছিল। ফলে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে গেছে। বাংলাবাজার এলাকায় রোববার দুপুরে কথা হয় রিকশাচালক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‌‘তিন দিন ধইরা তো জমা (ভাড়া) টাহাই ওডে না। হেইতে ঘরে বাজার-সদাই নিতে পারি না। ধার-কর্জ নিমু হেই অবস্থাও নাই, সবাইর অবস্থাই তো আমার নাহান। কষ্টের কথা কী কমু!’

বাড়ির সামনে পানি জমে গেছে। সেই পানিতে থালাবাসন ধুয়ে নিচ্ছে এক নারী। নবগ্রাম রোডে রোববার | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মৌসুমি বৃষ্টিপাত ছিল তলানিতে
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, চলতি বছর বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলে বৃষ্টির পরিমাণ একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে মাত্র ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ২৭ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলে বৃষ্টি ঝরেছে ২১ মিলিমিটার। আর মার্চে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৫৭ মিলিমিটার, হয়েছে ২৫ মিলিমিটার। সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে এপ্রিল মাসে। ওই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ১৩২ মিলিমিটার। কিন্তু বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৮৬ শতাংশ কম।

অন্যদিকে মে মাসে বরিশাল বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২৩২ দশমিক ৯ মিলিমিটার। কিন্তু হয়েছে বেশি, ৩৯৪ দশমিক ৫০ মিলিমিটার। এর মধ্যে মে মাসের শেষ দিকে ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।

এর অর্থ, বর্ষা মৌসুমে এবার স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়নি। হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই প্রবণতা বেশ কয়েক বছর ধরেই অব্যাহত আছে। এতে এবার এ অঞ্চলে ধারাবাহিক অস্বাভাবিক তাপমাত্রা মানুষকে বেশ ভুগিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, বরিশাল নগরের চারপাশ নদীবেষ্টিত। শহরের মধ্যে ২৪টি খাল ছিল এই শহরের আশীর্বাদ। এমনকি ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী ঝড়েও এখানে টিনের কাঁচা ঘরে পানি ওঠেনি। কিন্তু এখন একটু বৃষ্টি হলেই পানিতে গোটা শহর ডুবে যায়। মানুষ ঘরবন্দী হয়ে যায়। এর মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। খালগুলোকে মেরে ফেলা। যে সামান্য কয়টি টিকে আছে সেগুলোও দখলে-দূষণে মৃত। এগুলো যত দিন উদ্ধার করে সচল না হবে, তত দিন এ সমস্যা তো যাবেই না বরং পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।