তোফাজ্জলকে মেরে ফেলার আগে খাবার খেতে দেওয়া হয়েছিল (ওপরে)। গণপিটুনির পর ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ (নিচে) | ছবি: সংগৃহীত

সারফুদ্দিন আহমেদ: ভোরে বগুড়ায়, বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে;—একদিনে তিন লাশ পড়ে গেল।

উত্তেজিত জনতা (ভদ্দরলোকি ‘বাংলায়’ যাকে বলে ‘মব’) নিজেরাই কোটাল হয়ে ‘আসামি’ পাকড়াও করল, নিজেরাই ‘জাস্টিস’ তথা ‘কাজি’ হয়ে দণ্ড দিল এবং নিজেরাই জল্লাদ হয়ে তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলল।

‘পুলিশকে বলে লাভ নেই’-এই যুক্তির ওপর ভর করে তাৎক্ষণিক বিচারপ্রত্যাশী পাবলিকের এই তিনটি হত্যাকাণ্ডকে সাধারণ জনতা বলল ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’।

যেহেতু ‘জাস্টিস’ কথাটার আক্ষরিক মানে ‘ন্যায়বিচার’, সেহেতু ‘মব জাস্টিস’ কথাটার মধ্যে পাবলিকের একটা বড় অংশ এক ধরনের ন্যায্যতার মিশেল খুঁজে পেল।

এগুলোকে তারা আর স্রেফ অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ড বা খুন হিসেবে দেখল না। এর মধ্যে কোথাও যেন একটু ন্যায্যতার দ্যোতনা তারা খুঁজে পেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় আমরা জানলাম, ফজলুল হক মুসলিম হলে বুধবার সন্ধ্যার পর ‘মোবাইল ফোনচোর’ সন্দেহে শিক্ষার্থীরা তফাজ্জল নামের এক যুবককে ধরলেন।

সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা মুহূর্তে ‘মব’ হয়ে উঠলেন। মোবাইল চুরিকে তাঁদের কাছে জনগণের কোটি কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করে দেওয়ার চাইতে বড় চুরি ঠাওর হলো। তাঁরা চোরের বিচারে ‘জাস্টিস’ চর্চা শুরু করলেন।

মব তফাজ্জলকে গেস্টরুমে এনে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় ‘সাপ মারা’ মার দিল।

একপর্যায়ে মবের মনে হলো, খালি পেটে একটানা মারা হলে তফাজ্জলের প্রতি ‘ইনজাস্টিস’ হবে। মব তাকে হলের ক্যানটিনে নিয়ে ডাল-সবজি দিয়ে ভাত খেতে দিল। তফাজ্জলের পেট ভরল।

মবের জাস্টিস সেন্স তখন ভরা পেটের তফাজ্জলকে আরেক দফা মারার রায় দিল। 

এই মার আর তফাজ্জল নিতে পারলেন না। তিনি ঢলে পড়লেন। রাত ১২টার দিকে তাঁকে চেতনাহীন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক বললেন, বেশ আগেই তিনি মারা গেছেন। মব জাস্টিসে তফাজ্জল মর্গে চলে গেলেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ বিকেলে ক্যাম্পাসের একটি দোকানে ছিলেন।

১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় তিনি যুক্ত ছিলেন, এই অভিযোগে একদল শিক্ষার্থী তাঁকে পাকড়াও করেন। এরপরই শিক্ষার্থীরা ‘মব’ হয়ে ওঠেন।

মব তাৎক্ষণিকভাবে শামীমকে বেধড়ক পেটায়। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক জানান, তাঁর আগেই মৃত্যু হয়েছে।

আর বগুড়ার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, শেরপুর উপজেলায় ভোরে গরুচোর সন্দেহে আসিফ প্রামাণিক (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে মব পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

বুধবারের এই তিনটি ঘটনার বাইরে গত এক মাস ধরে মবের এই ধরনের বহু ‘জাস্টিস চর্চা’র ঘটেছে।

আদালত চত্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ওপর জনতার পচা ডিম নিক্ষেপ, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি ও আরিফ খান জয়ের ওপর হামলা, সাংবাদিক ফারজানা রুপাকে থাপ্পড় মারা, বিচারপতি মানিককে মারধরের ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনায় ন্যায়বিচারে প্রবলভাবে বিশ্বাসী অনেক লোককেও উল্লসিত হতে দেখেছি। তারাও হয়তো এটিকেই ‘উচিত সাজা’ সাব্যস্ত করেছেন।

এর মধ্য দিয়ে প্রচলিত বিচার ও সাজার আধুনিক মোড়ক ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁরা হয়তো নিজেদের মতো করে প্রাগৈতিহাসিক পীড়নের মৌতাত উপভোগ করেন।

২.

বিশ্বস্ত বন্ধু ব্রুটাসসহ উজির-নাজির-মোসাহেবরা ষড়যন্ত্র করে জুলিয়াস সিজারকে মেরে ফেললেন। প্রজারা গেল খেপে। জনতা হয়ে গেল ‘মব’ বা ‘উত্তেজিত জনতা’।

তারা চক্রান্তকারী সন্দেহে যাকে-তাকে ধরে পিটুনি দেওয়া শুরু করল। চক্রান্তকারীদের একজনের নাম ছিল চিন্না।

শুধু নাম মিলে যাওয়ায় ভুল করে মবের রোষানলে পড়ে গেলেন গেইয়াস হেলভিয়াস চিন্না নামের একজন নিরীহ কবি।

শেক্সপিয়ারের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্য-

চিন্না: কসম করে বলছি, আমার নাম চিন্না।

প্রথম সাধারণ প্রজা: ওকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলো! ও চক্রান্তকারী!

চিন্না: আমি কবি চিন্না! আমি কবি চিন্না! আমি ষড়যন্ত্রকারী চিন্না নই!

চতুর্থ প্রজা: চক্রান্তকারী চিন্না হোক আর না হোক, ওর নাম চিন্না তো! এটাই যথেষ্ট, ও যেসব ফালতু কবিতা লিখেছে, তার জন্যই ওকে ছিঁড়ে ফেলো!

শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে মারা গেলেন কবি চিন্না। ‘মব’ এমনই ভয়ানক জিনিস।

সম্প্রতি যেসব মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে জড়িত লোকদের আইনের আওতায় আনার উদাহরণ সরকার দেখাতে পারেনি। সর্বশেষ এই ঘটনাগুলো যদি সরকারের দিক থেকে আন্তরিকভাবে আমলে নেওয়া না হয় এবং দোষীদের গ্রেপ্তার করা না হয়, তাহলে এই মব জাস্টিস সংক্রামক হয়ে পড়তে পারে।

৩.

মব তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণের অপেক্ষা করে না। আইনের ধার ধারে না। মবের কাছে নিজের ধারণাই সাক্ষ্য। ধারণাই প্রমাণ। সুতরাং ‘পিটা! মাইরা ফ্যালা! জানে মাইরা ফ্যালা!’

মব ভুলে যায়, কেউ যদি সত্যি সত্যি গরুচোর, মোবাইল চোর কিংবা হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাও হয়, তাহলেও তাঁকে পেটানো যায় না। আইনত তো নয়ই, নৈতিক, ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো বিবেচনায়ই নয়।

পুরো ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানেন না-এমন লোককেও অনেক সময় গণপিটুনিতে যোগ দিতে দেখা যায়।

কোথাও হয়তো ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে মারা হচ্ছে, পাশ দিয়ে তিনি যাচ্ছেন। কিছু না জেনেশুনেই লোকটাকে তিনি ঘা কতক মেনে দিলেন।

‘হাতের সুখ’ নেওয়ার ইচ্ছে আছে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। তাই দল বেঁধে পিটুনি। সবাই মিলে মারলে দায় কারও একার থাকে না। পুরো বিষয়ই অ্যানোনিমাস হয়ে যায়।

জিনিসটা তখন মব জাস্টিস হয়ে যায়। মামলা জমে না। আসামিরও ঠিক ঠিকানা থাকে না।

উত্তেজিত জনতা ‘উত্তেজিত’ থাকে বলে তারা হয়তো আইনকানুন বা নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার বা প্রশাসনের নৈতিক বিস্মরণ ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

এখন প্রশাসনে অস্থিরতা আছে এবং পুলিশ শতভাগ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি—এমন একটি ধারণা জনমনে আছে। সেই ধারণা নৈরাজ্যমনস্ক লোকদের বেপরোয়া করে তুলছে।

সম্প্রতি যেসব মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে জড়িত লোকদের আইনের আওতায় আনার উদাহরণ সরকার দেখাতে পারেনি।

সর্বশেষ এই ঘটনাগুলো যদি সরকারের দিক থেকে আন্তরিকভাবে আমলে নেওয়া না হয় এবং দোষীদের গ্রেপ্তার করা না হয়, তাহলে এই মব জাস্টিস সংক্রামক হয়ে পড়তে পারে।

লেখক: সাংবাদিক