বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা নতুন সংবিধানের জন্য জনগণের নির্বাচিত সংসদকেই শ্রেয় বলে মনে করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার জন্য উচিত ছিল বিপ্লবী সরকার করা। সেটি হয়নি।
শনিবার সকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব বলেন, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়, তবে বিষয়টি কঠিন। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) উচিত ছিল বিপ্লবী সরকার করা। এই সংবিধানের অধীনে শপথ না নেওয়া। সেটা তো হয়নি। সংবিধানের অধীনেই তো শপথ নিয়েছে। তাহলে ওই জিনিসটাকে (বর্তমান সংবিধান) সামনে রেখে সেভাবে (সংশোধন) করতে হবে। আমরা নিজেরাই দল থেকে উদ্যোগ নিচ্ছি, সংবিধানের কী কী পরিবর্তন হতে পারে, সেই কাজ শুরু করেছি।’
এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিটির উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এঁরা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু দরের বিশেষজ্ঞ। তাঁরা খুবই ভালো করবেন। কিন্তু তার সঙ্গে মানুষের চাওয়াটাকে নিতে হবে।
অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময়ে অন্তর্বর্তী সরকার, এই সরকারের মেয়াদ, সংবিধান সংশোধনসহ এই সরকারের সংস্কার কার্যক্রম, শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানো, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের ঘটনাসহ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন মির্জা ফখরুল।
সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের জন্য গণপরিষদ করতে হবে
সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বক্তব্য হচ্ছে, সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে আগে মানুষের কাছে যেতে হবে, তারা কীভাবে সংবিধানের পরিবর্তনটা চায়...। আরেকটা বিষয় আছে, আমি-আপনি-আমরা কয়েকজন এক্সপার্ট (বিশেষজ্ঞ) মিলে করে দিলাম, সেটা একটা। কিন্তু সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা নতুন সংবিধান—এটা করতে হলে আপনাকে গণপরিষদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনমতের বিষয়টি তো আছেই, তারপরে আইনগত দিকগুলোও দেখতে হবে।’
সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের জন্য জনগণের ‘ম্যান্ডেট’কে (সমর্থন) সবচেয়ে নিরাপদ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, ‘আমি যে কথাটা শুরু থেকেই বলেছিলাম, নির্বাচনটা হোক। একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার করা দরকার-নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন—এগুলো সংস্কার করে নির্বাচনটা করে সেখানে আপনি সবকিছু করতে পারবেন। সংসদে প্রয়োজনীয় সব পরিবর্তন করতে পারেন। সবচেয়ে নিরাপদ হবে, জনগণের ম্যান্ডেটটা নিয়ে যদি আমূল পরিবর্তন করতে চান।’
যত দেরি হবে, তত দেশের ক্ষতি হবে
অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপির দেওয়া ‘যৌক্তিক সময়’ আসলে কত দিনের, জানতে চাওয়া হয়েছিল মির্জা ফখরুলের কাছে। জবাবে সুনির্দিষ্ট করে সময় বলা উচিত নয় উল্লেখ করেন তিনি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, কারণ এটা তো কাজের ব্যাপার। তবে যত দেরি হবে তত দেশের ক্ষতি হবে, তত সমাজের ক্ষতি হবে, রাজনীতির ক্ষতি হবে। কারণ পলিটিক্যাল গভর্ন্যান্সের (রাজনৈতিক শাসন) কোনো বিকল্প নেই।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এটা প্রমাণিত যে গণতন্ত্রই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। আর যখন গণতন্ত্র ভালো হবে, তখন জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা ওতপ্রোত হয়। বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জন্য কখনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু হত্যা মামলা হয়েছে। তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এখনো তাঁকে ফেরত চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নিশ্চয়ই তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) চিন্তা করছেন। তাদের উচিত হবে অতি দ্রুত তাঁকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। আমরা বলেছি, দেশের আদালতে তাঁকে ফেস (মুখোমুখি) করতে হবে, আইনের সামনে আসতে হবে।
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘উনি (শেখ হাসিনা) যদি সত্যিকারের রাজনীতিবিদ হন, তাঁর উচিত এখানে এসে ফেস করা, যেটা আমার নেত্রী (খালেদা জিয়া) করেছেন। তিনি লন্ডনে ছিলেন। চলে এসে ট্রায়াল (বিচার) ফেস করছেন, জেলেও গেছেন। এমনটাই রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত। এখন সরকারের উচিত হবে অতি দ্রুত তাঁকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত আছে
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতের বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাকে আমি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করি না। এর সঙ্গে শূন্যতার সুযোগ নেওয়া, ভূরাজনীতি—অনেক কিছু জড়িত আছে। সুতরাং এটাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখে এখনই কোনো মন্তব্য করাটা ঠিক হবে না। তবে আমি মনে করি, এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার একটা অংশ। প্রতি বিপ্লব ঘটানোর প্রক্রিয়ায় বিপ্লবের সুফলকে নস্যাৎ করার চক্রান্ত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, একটা বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরুর চেষ্টা।’
‘অন্যদিকে শেখ হাসিনা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যে সমস্ত কথা বলছেন, এটা কতটুকু সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। কিন্তু সেই কথাগুলো একটা প্রভাব তৈরি করছে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো খুব স্বস্তিদায়ক নয়। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সেই সঙ্গে আমার কাছে মনে হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলদের রাজনৈতিক সমস্যাগুলো হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতার অভাব আছে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে, তাতে আরও সমস্যা হচ্ছে।’ যোগ করেন মির্জা ফখরুল।
এর আগে আনসারদের ঘটনা, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও সংগঠনের দাবিদাওয়া নিয়ে অস্থিরতা তৈরি করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ‘প্রচণ্ড রকমের প্রক্রিয়া’র কথাও উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এ ঘটনাগুলো সরকারকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পিত ঘটনা, একেবারে বিপদগ্রস্ত করে ফেলানোর...। সেই সঙ্গে এটি দেশে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু করারও চক্রান্ত হতে পারে। আমরা মনে করি, বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া কখনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। রাজনীতি বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যাবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের অভিজ্ঞতার অভাব আছে
বিএনপির মহাসচিব মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনার ঘাটতি এবং তাদের অভিজ্ঞতার অভাব অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, ‘এই সরকারের যারা দায়িত্বে, এর বেশির ভাগই টেকনোক্রেটস, ব্যুরোক্রেটস ও একাডেমিশিয়ান। আর আছেন দুজন ছাত্রনেতা এবং কিছু এনজিওর কর্মকর্তা। এখানে সবচেয়ে বড় ল্যাকিং যেটা, সেটা পলিটিক্যাল। সেটা পূরণ করা যায়, যদি টাইম টু টাইম পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা যায়। সেটা বেশি সম্ভবও হচ্ছে না বোধ হয়, কিছুটা কম হচ্ছে।’
রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক, এমন মন্তব্য করে বিএনপির এই প্রবীণ নেতা বলেন, ‘পরিবর্তনটা পলিটিক্যাল, দীর্ঘ আন্দোলনটা পলিটিক্যাল। এখন সেই ক্ষেত্রে যদি ল্যাকিং হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে পলিটিক্যাল গ্যাপ (ঘাটতি) থেকে হতে পারে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের দেশে এ ধরনের (রাজনৈতিক) পরিবর্তনের পর গভর্ন্যান্সের একটা সমস্যা দেখা দেয়, বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের (অংশীজন) সমস্যা দেখা দেয়। সুযোগসন্ধানীরা একটা সুযোগ নিতে চায়। তদবির বেড়ে যায়। সবাই নতুন সরকারের কাছাকাছি যেতে চায়। এটা একটা বড় সমস্যা।’
ফ্যাসিবাদী সরকারে যাঁরা মূল দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা এখনো সে দায়িত্বেই রয়ে গেছেন উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, হত্যাকারীদের যাঁরা সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের এখনো বহু ক্ষেত্রে মূল জায়গাগুলোতে রেখে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক ঘটনা ঘটছে।