ফ্যাসিবাদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিত্রশক্তি গণ–অভ্যুত্থানকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। পাশে সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও মুখপাত্র সামান্তা শারমিন। ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

নিজস্ব প্রতিবেদক: মানুষ যেসব আকাঙ্ক্ষা থেকে আন্দোলনে নেমে এসেছিল, সেই সব আকাঙ্ক্ষা এখনো অধরা বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে কমিটি মনে করে, যেকোনো ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা খুবই মন্থর ও ধীরগতির। সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা গণ–অভ্যুত্থানের সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে যদি তারা ধারণ করতে না পারে, তা হবে দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

শনিবার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব বিষয় তুলে ধরেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ৮ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশের পর শনিবারই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেছে এই কমিটি। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও মুখপাত্র সামান্তা শারমিন।

সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে চলা মব জাস্টিস (বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর বিচার), মন্দির ও মাজার ভাংচুরের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। লিখিত বক্তব্যে কমিটি বলেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় মব জাস্টিস হতে দেখা গেছে। মন্দিরে, মাজারে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পূর্বশত্রুতার জের ধরেও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনার নিন্দা ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘অনেক দিন ধরে এসব ঘটনা ঘটলেও সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা আমাদের অবাক করেছে। আমরা জানি, ফ্যাসিস্ট সরকার টিকে ছিল তার প্রশাসন ও পুলিশ দিয়ে। ফলে তার পতনের পর প্রশাসন ও পুলিশকে ঠিকমতো কাজ করানো কঠিন হবে, তা আমরা জানতাম; কিন্তু পুলিশ ছাড়া অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নীরব থাকতে দেখেছি আমরা।’

লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ‘ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে শহরে আমরা ডাকাতির কাহিনি জেনেছি। সে সময় মানুষের সামাজিক প্রতিরোধ এ ঘটনা ঠেকিয়ে দিয়েছে। আমরা দেখেছি, বন্যার সময়ও সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা অপ্রতুল। দেশের বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়েছে। আমরা যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানালেও সেখানেও সরকার যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেনি। আজ এসবের পরম্পরায় মাজারের ওপর হামলা হচ্ছে।’

এসব ঘটনায় সরকারের কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া মানুষ আশা করছিল, সরকার তা পূরণ করতে পারেনি বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা আরও বলে, কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে না, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

এ কাজগুলো যারা করছে, তারা দেশ ও গণ–অভ্যুত্থানের শত্রু বলে মনে করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে এসব ঘটনার পেছনে কাদের উসকানি আছে তা খতিয়ে দেখতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কমিটি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ফ্যাসিবাদের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিত্রশক্তি গণ–অভ্যুত্থানকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ওই সব ঘটনা তাদের রসদ জোগাচ্ছে। আর যারা এসব ঘটাচ্ছে, তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছে।

ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের এক মাস হয়ে গেলেও ‘শহীদদের নামের তালিকা’ এখন সম্পূর্ণ না হওয়ার কথা উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি বলে, এ বিলম্ব গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক আহত আছেন, যাঁরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন না। সরকারের অবিলম্বে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন।

এক মাসের কাজের মূল্যায়ন
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের মূল্যায়ন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক কমিটিকে প্রশ্ন করা হয়। এর জবাবে কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, তাঁরা এখনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তাঁরা মনে করেন, সরকারের আরও দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে তাঁরা সরকারকে আরেকটু সময় দিতে চান। মাত্র সংস্কার কমিশনগুলো গঠন করা হয়েছে, তাদের কাজ দেখে নাগরিক কমিটি নিজেদের পর্যালোচনা জানাবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, তাঁদের প্রাথমিক আলোচনা হলো সংবিধানকে নতুন করে লেখা হবে। এর কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান হয়েছিল, সেখানে ’৭১–এর অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়নি। এই সংবিধান ছিল একদলীয়, সেখানে গণমানুষের অভিপ্রায় ছিল না। তিনি বলেন, এবারের গণ–অভ্যুত্থানে দল–মতনির্বিশেষে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তাঁদের সঙ্গে গণ–আলোচনার আয়োজন করে নতুন সংবিধান লেখা হবে। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা হবে, নাকি গণপরিষদ করে সংসদের মাধ্যমে তা গণ–আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে কত দিন সময় দেওয়া উচিত—এমন প্রশ্নের জবাবে নাসীরুদ্দীন বলেন, বিভিন্ন দল সরকারকে সময় দিচ্ছে। তাঁরা সরকারকে বলবেন, অতি দ্রুত কাজ শেষ করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে। কিন্তু সে কাজগুলো সমাধা করার জন্য সরকারকে সহযোগিতা ও পর্যালোচনা করতে হবে। নাগরিক কমিটি চায়, সংস্কার কমিশনগুলো দ্রুত কাজ শেষ করুক, যেসব সংকট রয়েছে, সরকার সেগুলো সামলে নিক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করুক। এটি কত দিনের মধ্যে করতে হবে, তা জনগণ ঠিক করবে। সরকার যদি না পারে, সেখানে জনগণ তাদের লড়াই জারি রাখবে। তিনি বলেন, যেসব সংস্কার কমিশন করা হয়েছে, সেগুলো এক–দুই মাস কাজ করলে তখন সময়ের বিষয়ে বলা যাবে—ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর, আড়াই বছর বা তিন বছর।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর দায়িত্ব ছিল একটি নির্বাচন দেওয়া; কিন্তু যখন সরকারকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য বলা হয়, তখন কতটুকু সময় দেওয়া হবে, সেটি বিবেকের কাছে বিবেচ্য। তাঁরা সরকারের কাজ পর্যালোচনা করে একটি সময় বেঁধে দিতে পারবেন।

আরেক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় অনেককে সরকারে আসার জন্য বলা হয়েছিল। তখন তারা বলেছিল, তারা সরকারের বাইরে থাকবে। তারা নির্বাচন করবে।

এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, গণ–অভ্যুত্থানে হাজারের ওপর মানুষ শহীদ হয়েছেন। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হাসপাতালগুলোতে এখনো অনেকে চিকিৎসাধীন। পাঁচ শর বেশি মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁরা হতাশার কথা জানিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না দেখায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সরকারকে সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা করা এবং শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

রাজনৈতিক দল নয়, উদ্যোগ রাজনৈতিক
৮ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আত্মপ্রকাশের দিন প্রাথমিকভাবে নিজেদের আটটি কাজের কথা বলেছিল জাতীয় নাগরিক কমিটি। গতকালের সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়টি তুলে ধরেছে তারা।

এর মধ্যে রয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হওয়া সামষ্টিক অভিপ্রায় ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সমুন্নত রাখা। রাষ্ট্রের জরুরি সংস্কার ও পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা ও জবাবদিহির পরিসর তৈরি। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে আলোচনা, মতবিনিময় ও গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের জনতাকে সংহত করার লক্ষ্যে কাজ করা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নীতিনির্ধারণী প্রস্তাব তৈরি ও সেটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ। গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণ-আলোচনার আয়োজন করা।

জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই কমিটি কোনো রাজনৈতিক দল নয়; কিন্তু এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের লক্ষ্যে নাগরিক কমিটি সক্রিয় থাকবে। গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে তারা হারিয়ে যেতে দেবে না।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জাতীয় নাগরিক কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, জনগণসহ সব রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাতীয় ঐক্য তৈরি করা। যে ঐক্যের ওপর দাঁড়িয়ে শোষণহীন, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা যাবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হয়েছে; কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনো বিলোপ হয়নি। ফ্যাসিবাদ স্রেফ একটি সরকার নয়; এটি একটি ব্যবস্থা যা বিভিন্ন আইন, প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক চর্চার মাধ্যমে টিকে থাকে। নাগরিক কমিটি এমন একটি বন্দোবস্ত তৈরি করতে চায়, যাতে সামনের দিনে কোনো সরকারপ্রধানকে শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যেতে না হয়। সব রাজনৈতিক পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা নতুন বন্দোবস্তের পথ তৈরি করতে চান।

সামান্তা শারমিন বলেন, ‘যারাই অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করুন। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ। ফলে যারা মব জাস্টিসসহ নানান কিছুতে অংশগ্রহণ করছে, তাদেরও গ্রেপ্তারের দাবি আমরা জানাচ্ছি।’