রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা ফটক থেকে শেরে বাংলা ফজলুল হক হল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত প্যারিস রোডে রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: বরেন্দ্র অঞ্চল প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের অপার মাধুর্যের এক অনন্য বাতিঘর, যার প্রাণকেন্দ্র রাজশাহী। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার সমৃদ্ধিতে ঘেরা এই অঞ্চল পর্যটনের সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে এখন প্রয়োজন শুধু পর্যটনবান্ধব কার্যকর পদক্ষেপ।
রাজশাহীতে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিখ্যাত বাণিজ্যিক কেন্দ্র ‘বড়কুঠি’ এবং ঐতিহাসিক ‘ঢোপকল’ থেকে শুরু করে দেশের প্রথম ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’ শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। গ্রিন, ক্লিন ও হেলদি সিটি খ্যাত এই নগর এখন বৈচিত্র্যময় রূপের কারণে নতুন নতুন নামে পরিচিত হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগরসহ জেলার ৯টি উপজেলায় প্রত্নতত্ত্ব, পুরাকীর্তি এবং ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থাপত্যের প্রাচুর্য দেখা যায়। বরেন্দ্রের ছোট্ট এই ভূখণ্ড 'স্মার্ট সিটি'র পরিচয়ে পর্যটনের সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। রাজশাহী এখন রেশম নগরী, শিক্ষা নগরী, আমের রাজধানী, শান্তির নগরী, সবুজ নগরী, ওলি-আওলিয়ার নগরী, আলোর নগরী, মিনি ইউরোপ, স্মার্ট সিটির মতো বিভিন্ন নামে সমাদৃত।
কমিউনিটি ট্যুরিজমের মাধ্যমে রাজশাহীর পর্যটন সম্ভাবনাকে আরও বিকশিত করতে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, যা এ অঞ্চলের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা জাগাচ্ছে।
রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। নগরের হেতেম খাঁ এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রত্নতত্ত্ব
দেশের প্রত্নতত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’। এটি রাজশাহীর হেতেম খাঁ এলাকায় অবস্থিত এবং দেশের প্রথম জাদুঘর হিসেবে এর একটি বিশেষ গৌরব রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত এই জাদুঘরটি রাজশাহীর গর্ব। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজা ও সমসাময়িক পণ্ডিতজনেরা ১৯১০ সালে এটির ভিত্তি স্থাপন করেন। নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎকুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রমাপ্রসাদ চন্দের অসামান্য ভূমিকা ছিল এই প্রতিষ্ঠানে।
এ জাদুঘরে প্রস্তর ও ধাতব ভাস্কর্য, টেরাকোটা, মুদ্রা, পাণ্ডুলিপি, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ফলক, অস্ত্রশস্ত্র, চিত্রকর্ম, ধাতব সামগ্রী এবং শিলালিপিসহ প্রায় ১৯ হাজার প্রত্ননিদর্শন রয়েছে। তবে জায়গার অভাবে বর্তমানে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অচিরেই সব প্রত্ননিদর্শন উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই জাদুঘর পরিচালিত হচ্ছে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে গঙ্গামূর্তি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরটি স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অনেক বিদেশি গবেষক এখানে আসেন বিশেষভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে। সম্প্রতি জাদুঘরের কিছু উন্নয়ন কাজও সম্পন্ন হয়েছে, যা এই অঞ্চলের পর্যটন শিল্পকে আরও বিকশিত করতে সহায়ক হবে।
পুরাকীর্তি
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাংলায় এসে ওলন্দাজরা রাজশাহীর পদ্মার তীরে এই ‘বড়কুঠি’ ভবন নির্মাণ করেছিল | ফাইল ছবি |
পুরাকীর্তির দিক থেকেও রাজশাহী জেলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মহানগরীসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এগুলো পরিদর্শন এবং গবেষণার জন্য নিয়মিত আসছেন।
রাজশাহীর বোয়ালিয়ায় রয়েছে ঐতিহাসিক বড়কুঠি। পবায় রয়েছে বাঘবানী ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। পুঠিয়ায় রাজবাড়ি এবং এর আশপাশে রয়েছে আহ্নিক মন্দির, বড় গোপাল মন্দির, জগধাত্রী মন্দির, দোল মন্দির, বড় শিব মন্দির, রথ মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, গোপাল মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, বড় আহ্নিক মন্দির, সালামের মঠ, খিতিশ চন্দ্রের মঠ, কেষ্ট ক্ষেপার মঠ ও হাওয়া খানা।
সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাঘা মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
দুর্গাপুরে রয়েছে কিসমত মারিয়া মসজিদ এবং বিবির ঘর। বাঘা উপজেলায় বিখ্যাত বাঘা মসজিদ অবস্থিত। গোদাগাড়ীতে রয়েছে কুমারপুর ঢিবি মাজার, উপর বাড়ি মাউন্ড এবং মকরমা মাউন্ড। এছাড়াও দেওপাড়া দিঘি ও দরগাহ, আলী কুলি বেগের মাজার, তানোরে ধানোরা ঢিবি ও বিহারাইল ডিবি, এবং বাগমারার বীরকুৎসা জমিদার বাড়ি ও গোয়ালকান্দি জমিদার বাড়ির মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য রয়েছে।
এই সব পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট দফতর এবং স্থানীয় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে, যা এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করছে।
সৌন্দর্য
রাজশাহীর পদ্মা নদী | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহী মহানগরীর সৌন্দর্যের খ্যাতি এখন আর দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নির্মল বায়ুর এই শহর নানা রূপ ও গুণে পরিচিত হচ্ছে। প্রমত্তা পদ্মার তীর ঘেঁষা এই শহর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এবং প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। এখানে সবুজ আর নির্মল বায়ুর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সময় কাটানো যায়।
মহানগরীর প্রায় ১২ কিলোমিটার পদ্মার পাড়জুড়ে রয়েছে সৌন্দর্যের বিশাল সম্ভার। যদি পুরো ১৭ কিলোমিটার পদ্মার বাঁধ দখলমুক্ত করে পর্যটনবান্ধব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে প্রচুর দর্শনার্থী আকৃষ্ট হবে। পদ্মার পাড়কে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন হাব গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মার চরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই এখানে অনেক দর্শনার্থী আসেন। অনেকেই এ জায়গাটিকে কক্সবাজারের সঙ্গে তুলনা করেন। ইতোমধ্যে কিছু পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন, যদি কর্তৃপক্ষ সঠিক পদক্ষেপ নেয়, রাজশাহী দ্রুতই পর্যটন শহর হিসেবে পরিচিতি পাবে।
ঋতুভেদে পদ্মাপাড় এবং জেলার মেঠোপথের সৌন্দর্যে পরিবর্তন আসে। পড়ন্ত বিকেলে পদ্মাপাড়ের মুক্ত বাতাস ও নয়নাভিরাম দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পদ্মায় পানি থাকুক বা না থাকুক, এখানকার নির্মল বাতাস মনকে প্রশান্ত করে। নদীর পাড়ে জেগে ওঠা বালুচরে ক্ষুদ্র বনভূমি রয়েছে, যা ভিন্ন ধরনের ভ্রমণের আনন্দ দেয়।
পদ্মাপাড়ে রয়েছে পদ্মা গার্ডেন, লালনশাহ মুক্ত মঞ্চ, আই-বাঁধ, টি-বাঁধ, শিমলা পার্ক এবং সীমান্তে নোঙ্গর করা স্থানগুলো অন্যতম সুন্দর স্পট। বুলনপুর আই-বাঁধের নতুন সৌন্দর্যও দর্শনার্থীদের মন কেড়েছে। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও নৌ-পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাজ করছে, যা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
মহানগরীর সড়কগুলোতেও ভ্রমণের আনন্দ রয়েছে, বিশেষ করে রাতে আলোকসজ্জিত নগরী দেখে সড়কগুলো যেন পর্যটন স্পট হয়ে ওঠে। ভদ্রা পারিজাত লেক, সপুরা মঠপুকুরসহ মহানগরীর প্রতিটি মোড় ভিন্ন সৌন্দর্যের অধিকারী। এছাড়া বোটানিক্যাল গার্ডেন, নভোথিয়েটার এবং হাইটেক পার্ককে কেন্দ্র করে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি পর্যটনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
ঐতিহ্য
কালাইরুটির আদি নিবাস চাঁপাইনবাবগঞ্জ হলেও এখন এটি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো রাজশাহী বিভাগজুড়েই | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
রাজশাহীর খাবার থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যসহ নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রয়েছে। রাজশাহী ঘুরতে এসে পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় থাকে বিখ্যাত কলাই রুটি। তেমনি রাজশাহীর আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও তাদের মুগ্ধ করে। শীতকালে খেজুরের রসের আপ্যায়ন, বছরজুড়ে বাহারি ফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য এবং রাজশাহীর মানুষের সহজ-সরল, অতিথিপরায়ণ জীবনযাত্রা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এসব অভিজ্ঞতা ভ্রমণপিপাসুদের মনে ভিন্ন এক নান্দনিক ও মায়াবী রূপের গল্প এঁকে দেয়, যা তাদের জন্য অনন্য এক স্মৃতি হয়ে থাকে।