আসা-যাওয়ায় বিদ্যুৎ, জনজীবন অতিষ্ঠ

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘অইদোত সারা দিন কাম করি। গরমে জাহান যাওয়া-আইসা করে। বাড়িত আসি যে একনা জুড়ামো, সেটাও হয় না। খালি কারেন যায় আর কারেন যায়। কারেন না থাইকলে বিল যে কম করি আইসপে, সেটাও নাই। বিল ভালোই আইসে। মোর ধারণা, মিটারগুলাতে ওমরা ভেজাল করি থুইছে।’

কথাগুলো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মো. মেহের আলীর স্ত্রী নাজমা বেগমের। কয়েক দিন ধরে অব্যাহত তাপপ্রবাহের মধ্যে ভয়াবহ বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে তাঁর মতো অনেকের জীবন অতিষ্ঠ।

এর মধ্যে বুধবার মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করেছেন স্থানীয়রা। 

এদিকে এমন পরিস্থিতি আরও কিছুদিন থাকবে এমন আভাস মিলেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কথায়। তিনি জানিয়েছেন, আগামী ২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

দিনে-রাতে সমানতালে লোডশেডিং
চলছে অসহনীয় তাপপ্রবাহ। দিনে প্রখর রোদ, রাতে ভ্যাপসা গরম। এর মধ্যে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে বিদ্যুৎ। ভুক্তভোগীরা জানান, দিনে-রাতে কতবার যে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করে, তার হিসাব নেই।

ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে মো. আংগুর মিয়া বলেন, ‘নামাজে বসবেন, বিদ্যুৎ নাই; ভাত খাবেন, বিদ্যুৎ নাই; পড়ার টেবিলে বাচ্চারা বসবে, বিদ্যুৎ নাই। দিন শেষে পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় যাব, তখনো লোডশেডিং। মাস শেষে বিদ্যুৎ বিলটা ঠিকই আসে। বিষিয়ে উঠাচ্ছে মন-মেজাজ। মনে হয় মিটার ভেঙে ফেলি। আর না হয় কারেন্টের তার ছিঁড়ে ফেলি।’

রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সুন্দরগঞ্জের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল বারী বলেন, ‘এখানে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ দিতে গেলে ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু বরাদ্দ পাই ১০ মেগাওয়াট। সে কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। এখানে আমাদের করার কিছুই নাই।’

মিটারে কোনো ধরনের ঘাপলা আছে কি না জানতে চাইলে আবদুল বারী বলেন, ‘ডিজিটাল মিটারের সেনসিটিভিটি এত বেশি যে মিটারে থাকা লাল বাতিটা জ্বললেও মিটারের চাকা ঘুরবে। অর্থাৎ বিল উঠবে। আর অ্যানালগ মিটারগুলোতে মোবাইল ফোন চার্জ দিলেও মিটারের চাকা ঘুরত না। অ্যানালগ পাল্টে ডিজিটাল মিটার স্থাপন এটি সরকারি সিদ্ধান্ত।’

হরিরামপুরে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জোনাল শাখা অফিস ঘেরাও করেছেন ছাত্র-জনতা। বুধবার সকালে হরিরামপুরের সাধারণ ছাত্র-জনতার ব্যানারে পল্লী বিদ্যুতের লাগামহীন লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে মিছিল নিয়ে অফিস ঘেরাও করেন তাঁরা। এ সময় আন্দোলনকারীরা ‘লোডশেডিং কমিয়ে দে, নইলে চাকরি ছেড়ে দে’—এমন স্লোগান দেন। পরে তাঁরা ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় কোনো লোডশেডিং চলবে না’সহ ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি হরিরামপুর জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সামিউল কবির বলেন, ‘হরিরামপুরে চাহিদার ৪০-৫০ ভাগ বিদ্যুৎ পাই। যতটুকু পাই ততটুকু বিতরণ করি। উৎপাদন না বাড়লে লোডশেডিং কমার সম্ভাবনা কম।’

ডিমলায় ১৪ ঘণ্টা থাকছে না বিদ্যুৎ
নীলফামারীর ডিমলায় দুই সপ্তাহ ধরে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এর মধ্যেই যোগ হয়েছে অসহনীয় লোডশেডিং। দিনে ও রাতে ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। এতে অনেকটাই বিপর্যস্ত রোগী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ। ভয়াবহ এ লোডশেডিংয়ে বিপাকে পড়েছেন আমনচাষিরা। শ্যালো মেশিনেই ভরসা করতে হচ্ছে তাঁদের। সুন্দর খাতা এলাকার কৃষক হাবিবুল হাসান বলেন, ‘এবার তীব্র খরা ও অনাবৃষ্টিতে খেতের মাটি শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। বৃষ্টি না থাকায় ও লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে আমন ধানের আবাদ করতে অনেক খরচ গুনতে হচ্ছে।’

২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিংয়ের উন্নতি হবে
আগামী ২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বুধবার দুপুরে রাজধানীর সচিবালয়ে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) নির্বাহী কমিটির সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ তথ্য জানান।

ফাওজুল কবির বলেন, ‘হঠাৎ করে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে রামপালের একটি ইউনিটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে এই সংকট সামাল দেওয়া সহজ হতো। কিন্তু সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) কয়েক মাস ধরে বিকল থাকায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এলএনজি আমদানির কাজ চলছে, ১৫-২০ দিন সময় লাগবে। তারপর গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। গ্যাস-সংকটের কারণে শুধু আমরা না, শিল্প, সার কারখানা—সব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে।’

উপদেষ্টা বলেন, ‘বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রামপাল দ্রুত চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি হবে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’