পদ্মায় নদীভাঙনের কারণে কেউ কেউ তাদের গবাদিপশু নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী: পদ্মা নদীর ডান তীরের ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন চরের কয়েকটি গ্রামে গত এক সপ্তাহ ধরে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। চরে পানি উঠে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি ও ফসল। ভাঙনের আতঙ্কে অনেকেই তাঁদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন, আর কেউ কেউ গবাদিপশু নিয়ে মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা ও নারায়ণপুর এলাকাতেও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রায় ছয় হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে, আর নাটোরের লালপুর উপজেলায় তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি।
গত এক সপ্তাহ ধরে চরের বাসিন্দারা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। নৌকায় তুলে এপারে নিয়ে আসছেন, খুঁজছেন নতুন আশ্রয়। বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রেলবাজার ঘাটে এমনই কয়েকটি নৌকা এসে পৌঁছায়। কোনো নৌকায় গরু-ছাগল, কোনো নৌকায় ধান, আবার কোনো নৌকায় ভাঙা বাড়ির চালা, টিনের ছাউনি, ও আসবাবপত্র ছিল।
চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চর বয়ারমারি গ্রামের বাসিন্দা আসগর আলী বলেন, প্রতিবছর তাঁদের গ্রাম পদ্মায় ভেঙে যায়। এরই মধ্যে তিনি ১৫ বিঘা কৃষিজমি হারিয়েছেন, এবং বাড়ি সরিয়েছেন ছয়বার। এবারও নদীর ভাঙন বাড়ির কাছে চলে আসায় তাঁরা নদীর এপারে এসে মাছমারা গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছেন।
চর আমতলা খাসমহলের বাসিন্দা আলাউদ্দিন জানান, কয়েকদিনের পানি বৃদ্ধিতে তাঁদের এলাকার বেশ কিছু রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। টমেটো ও ধানের খেত ডুবে গেছে। চর বয়ারমারি গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবারকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার জেলেপাড়া গ্রামেও তীব্র ভাঙন চলছে। পোলাডাঙ্গা এলাকায় একটি সেতু ছিল, যা নদীভাঙনের কারণে ভেঙে গেছে।
পদ্মার ভাঙনের প্রভাবে রাজশাহীতে চরের বাসিন্দারা তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নৌকায় করে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এদিকে রাজশাহী নগরীর ওপারে চর মাজারদিয়াড় এলাকায় কিছু ফসলি জমি তলিয়ে গেলেও সেখানে ভাঙন নেই। তবে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চক নারায়ণপুর ইউনিয়নে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ফতেপুর পলাশি রাস্তার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ভাঙনের কারণে আতারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, এবং চৌমাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। আতারপাড়া, চৌমাদিয়া, ও দিয়াড়কাদিরপুর গ্রামের প্রায় ৭৫০টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। গত এক সপ্তাহে এসব এলাকার বেশ কিছু বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।
চরখিদিরপুর থেকে প্রায় ৫০০টি গরু নিয়ে মেহেরচণ্ডি ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নিয়েছেন চরের বাসিন্দারা। আলমগীর হোসেন নামে একজন বলেন, কয়েকদিনের পানি বৃদ্ধিতে চরের ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। আটজন মালিকের ৫০০টি গরু নিয়ে তাঁরা এখানে আশ্রয় নিয়েছেন, কারণ তাঁদের আর কোনো যায়গা নেই।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নাটোরের লালপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এছাড়া রাজশাহীতে ৯ হাজার ৬৮১ বিঘা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৪ হাজার ৮৫৭ বিঘা ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। লালপুরের বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের নওশারা সুলতানপুর, চাকলা বিনোদপুর, দিয়াড়শংকরপুর, আরাজি বাকনাই, রসুলপুর ও মোহরকয়া আংশিকসহ প্রায় ১৮টি চর এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বেড়েছে। তবে বৃহস্পতিবার সকালে কিছুটা কমতে শুরু করেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় পানির উচ্চতা ছিল ২১ দশমিক ৫ মিটার, যা সকাল ৯টায় এক সেন্টিমিটার কমে ২১ দশমিক ৪৯ মিটার হয়েছে। এ পয়েন্টে বিপৎসীমা ২২ দশমিক ০৫ মিটার। রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ও সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৯ মিটার। পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ও সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা ছিল ১২ দশমিক ৩৮ মিটার, যেখানে বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ২৫ মিটার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় পানি বিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, পদ্মার পানি গত এক সপ্তাহ ধরে বেড়েছে, তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে পানি কমতে শুরু করেছে, ফলে ভাটিতেও পানি কমবে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন পানি হ্রাস পেতে পারে।