চিররঞ্জন সরকার
গ্রাফিক: পদ্মা ট্রিবিউন |
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা সমাগত। কিন্তু এই উৎসবকে ঘিরে তেমন কোনো উৎসাহ নেই। বরং পূজা নিয়ে শঙ্কা ও ভয় বাড়ছে। দেশে এখন উগ্রবাদীদের জয়জয়কার। তারা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে মাঠে নেমেছে। কখনো চাঁদা দাবি করছে। কখনো নতুন নতুন ফতোয়া জারি করছে। মাত্র কয়েকদিন আগে একটি ধর্মীয় সংগঠন প্রতিমার পূজা করা যাবে না এবং বিসর্জন দেওয়া যাবে না বলে ফতোয়া দিয়েছে। সেই সঙ্গে দুর্গাপূজার সময় কোনও ছুটি দেওয়া যাবে না বলেও দাবি তুলেছে। ভারত যেহেতু বাংলাদেশের ‘জাতীয় শত্রু’ তাই এদেশের হিন্দু নাগরিকদেরও ভারতবিরোধী হতে হবে বলেও দাবি করেছে তারা। এই কারণে, ভারত-বিরোধী ব্যানার এবং স্লোগান মন্দিরে রাখা উচিত বলেও দাবি তাদের।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে শান্তিতে পূজা করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। দুর্গাপূজা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে করার যায় সেই জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও জানানো হয়েছে। তারপরও ভয় কাটছে না।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন একটা স্থায়ী ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অথচ জুলাই অভ্যুত্থান আশা দেখাচ্ছিল, অন্তত অভ্যুত্থানের সময় এবং অব্যবহিত পরে দেশজুড়ে ভাসানীর ধর্ম আর দেশ না মেলাবার বাণী আঁকার মতো বৈষম্যবিরোধী অজস্র গ্রাফিতি করা হয়েছিল। যারা এই আশার বাণী উৎকীর্ণ করছিল দেয়ালজুড়ে তারা এখন আর নীতিনির্ধারণের কোথাও নেই। অন্য সব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মতোই পরিস্থিতি হয়েছে আবার।
ধর্মীয় সম্প্রীতির গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে দেয়ালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
যখনই দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, তখনই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়। এদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও নির্বাচনের সঙ্গে এই সংখ্যালঘু ইস্যুটির একটি সংযোগ তৈরি হয়েছে। গত চার দশকের রাজনীতিতে দেখা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনের আগে-পরে কিংবা কোনো দল ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ সামনে এসেছে। গত চার দশক ধরে এই ধারা চলছে।
এর মধ্যে একটি ঘটনা ছিল প্রতিবেশী দেশে সংঘটিত ঘটনার প্রতিক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে হিন্দুদের ওপর প্রথম বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯২ সালে, ভারতে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার সময়। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর হিন্দুদের ওপর বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবার পরে। নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করার পরপরই দেশের বেশ কিছু জেলায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। যদিও তখন ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানে নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের দিন থেকে শুরু করে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করার পরেও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল। এসবের পেছনে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল।
এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ আসে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে, ৪ অগাস্ট থেকে ২০ অগাস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯ জনকে হত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ/গণধর্ষণ, ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ; ৯১৫টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৯৫৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; বসতবাড়ি দখল একটি; ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।
যদিও এসব হামলা-নির্যাতনের ঘটনাকে দেশের ক্ষমতাসীন মহল স্বীকার করেনি। অনেকে এগুলোকে, গুজব, অপপ্রচার নাটক বলেও উড়িয়ে দেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনাগুলো কখনো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। এসব হামলার ক্ষেত্রে এক ধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। এসব হামলার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল অতীতে তাদের বিচার কখনো হয়নি। ফলে এটি থামছে না।
এদেশে ভারত, হিন্দু এবং আওয়ামী লীগ– এ তিনটি বিষয়কে একটি রেখায় চিন্তা করা হয়। হিন্দুদের মনে করা হয় আওয়ামী লীগের সমর্থক। আবার আওয়ামী লীগকে মনে করা হয় ভারতের সমর্থক। ফলে ভারতবিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার বিষয়টি সামনে এলেই সবার আগে টার্গেট করা হয় হিন্দুদের। হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলে বলা হয়, ওগুলো রাজনৈতিক। ওরা আওয়ামী লীগের দালালি করে বলে ওদের ওপর এই আক্রমণ। এদিকে চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। এগুলো যে সাম্প্রদায়িক হামলা, সেটা বেশিরভাগই স্বীকার করে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এখনো চলমান আছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করা হলেও দেশের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলছে, ‘‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বাড়িঘরে, কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। হামলা শুরু হয় মূলত গত ৫ আগস্ট বিকেল থেকে। প্রথম দুই দিন হামলার ঘটনা বেশি ঘটে। ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে হামলা হয়েছে ২২টি উপাসনালয়ে (প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)।’’
উল্লিখিত প্রতিবেদনটি একটি খণ্ডিত অংশ। এর চেয়েও অনেক বেশি হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। কোনো কালেই কোনো সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি । হিন্দুরা এদেশের নাগরিক। নাগরিক হিসেবে তাদের সমান অধিকার প্রাপ্য। যে কোনো নাগরিকের উপর অন্যায় হলে আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা কখনো হয় না। বরং সব সময়ই সংখ্যালঘুদের বলির পাঁঠা বানানো হয়। এসব ঘটনায় কারো কোনো বিচার হয় না বলেই এটা বারবার ঘটতে থাকে। আসলে দুষ্কৃতকারীদের পেছনে এত ব্যাপক সমর্থন রয়েছে যে তারা আর ভয় পায় না। আর তারা জানে এসব করে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস হিন্দুসহ সকল জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার উপর বিশেষভাবে নজর দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তিনি এমন একটা বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান যেখানে সবাই নির্ভয়ে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবেন। সেখানে কোনও মন্দির পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের ছিটে-ফোঁটাও এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ধর্মব্যবসায়ী ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিকারী অপশক্তি আরও শক্তিশালী ও সক্রিয় হয়েছে। ফলে দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা এখন আরো বেশি বিপদাপন্ন হয়েছে। হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এখনো আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সেখানে সীমাহীন সহিংসতা ঘটলেও এখনো দোষীদের চিহ্নিত করা হয়নি। গ্রেপ্তার ও বিচার করা হয়নি। বরং একতরফাভাবে পাহাড়িদের উপর দায় চাপানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিল ভূমিকার কারণে সারাদেশেই হিংস্রতা ও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড বাড়ছে বাড়ছে বল্গাহীনভাবে। যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, তাদের অনেককেই জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক সংগঠনের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি সন্ত্রাসী জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত অনেক দাগী আসামিকেও মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিরাপত্তার শঙ্কা এবার বেড়েছে।
এই মুহূর্তে যেকোনো সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও যেকোনো ধরনের হামলা-নির্যাতন বন্ধ করা সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। দুর্গাপূজাকে নির্বিঘ্ন করা এবং এ দেশে বসবাসকারী হিন্দুসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। নিরাপদে বসবাস করা ও নির্বিঘ্নে উৎসব পালন করা হিন্দুদের মৌলিক অধিকার। ভারতকে ঘিরে যত কলঙ্কই আরোপ করা হোক না কেন, হিন্দুরা এদেশেরই নাগরিক। এদেশেই তাদের সাত-পুরুষের বাস। তারা অন্য কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এই দেশ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের। একটি উদার, গণতান্ত্রিক, মানবিক, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকল ধর্মের মানুষকে একত্রে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু কথায় নয়, নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সকলকে কাজ করতে হবে। কাজ দিয়েই সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।