নিহত আবদুল্লাহ আল মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা কোলে নবজাতক সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন। সোমবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের খাসেরহাট মাদ্রাসাপাড়ার বাড়িতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে (৩১) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দুই দিনেও কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলের মানুষ কেউ মুখ খুলছেন না।
৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়। পরে তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মারা যান। ময়নাতদন্তের পর গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর গোরস্থানে (বাড়ির পাশের গ্রাম) মাসুদকে দাফন করা হয়েছে।
গতকাল দুপুরে লাশ নেওয়ার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা তাঁর পাঁচ দিনের সন্তানকে কোলে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মেয়ের নাম এখনো রাখা হয়নি। তিনি জানান, আকিকা দিয়ে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখার কথা ছিল মাসুমা আক্তার। সেই আকিকা আর দেওয়া হলো না।
আজ সোমবার বিকেল পর্যন্ত মাসুদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কেউ থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেননি। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, কিন্তু সেখানকার কোনো মানুষ মাসুদকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়ে তথ্য দিচ্ছেন না। যাঁরা তাঁকে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদেরও পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনার পর মতিহার থানায় রমজান নামের এক লোক জানতে গিয়েছিলেন, মাসুদের নামে ওই থানায় কোনো মামলা ছিল কি না। মামলা না থাকার কথা শুনে তাঁরা নগরের বোয়ালিয়া থানায় আহত মাসুদকে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
মাসুদকে আহত অবস্থায় বোয়ালিয়া থানায় আনার পর তাঁর কথাবার্তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বোয়ালিয়া থানা হাজতে শুয়ে থাকা অবস্থায় মাসুদকে বলতে দেখা যায়, ‘আমি বিনোদপুরে ওষুধ নিতে এসেছিলাম ভাই। আমি ছাত্রলীগ করতাম ওই জন্য ধরেছে। কিন্তু আমার পা ২০১৪ সালে কেটেছে ভাই। রগ-টগ সব কাটা ভাই। আমি তো অনেক দিন আগে থেকেই ছাত্রলীগ করা বাদ দিয়েছি ভাই।’
আবদুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না জানতে চাইলে উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘আজ পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মামলার বিষয়টি আমাদের আলোচনার মধ্যে রয়েছে।’ উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমার তরফ থেকে বারবার জনসংযোগ দপ্তরকে বলেছি, যেন কেউ আইন নিজের হাতে তুলে না নেন। এটার ব্যাপারে সতর্ক আছি। পরিবার মামলা না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে করা হয়। আমরা সেই দিকে তাকিয়ে আছি।’
রাজশাহীতে পিটুনিতে নিহত আবদুল্লাহ আল মাসুদের মা তাসেনুর বেগম। সোমবার দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের খাসেরহাট মাদ্রাসাপাড়ার বাড়িতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ছাত্রজীবনে আবদুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি নগরের বুধপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন আবদুল্লাহ আল মাসুদ। এতে মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাঁ পা-ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয়েছিল তাঁর হাতের রগ। এ ঘটনায় সে সময় শিবিরের নেতা-কর্মীদের আসামি করে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। এ হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। তাঁর অন্য পা গত শনিবার রাতে ভেঙে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন মাসুদ। এরপর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মীর তাফেয়া সিদ্দিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে আবদুল্লাহ আল মাসুদকে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেন।
রাজশাহীতে শনিবার দিবাগত রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে | ছবি: মাসুদের ফেসবুক আইডি থেকে নেওয়া |
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ আল মাসুদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন তিনি। সেই থেকে তিনি এ পদেই চাকরি করতেন। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কন্যাসন্তানের বাবা হন মাসুদ।
শনিবার নবজাতক শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাসুদ লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার। গত ৩/৯/২০২৪ তারিখে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছি। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি। সকল আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার ও আমার মেয়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি।’
পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কে
‘প্রায় পঙ্গু একটা মানুষ হওয়ার পরও নির্মমভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছে আমার ভাইকে। চিকিৎসা তো দূরের কথা, মৃত্যুর আগে একফোঁটা পানিও চেয়ে পায়নি আমার ভাইটা। তাঁকে মারধর করে থানায় নিয়ে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধেই মামলা দিতে চায় হামলাকারীরা। এখন তো আমরা মামলা করতে রাজশাহীতে যেতেই ভয় পাচ্ছি। মামলা করে কি বিচার পাব?’
আবদুল্লাহ আল মাসুদের বড় ভাই আয়াতুল্লাহ বেহেস্তী কথাগুলো বলছিলেন। তাঁর সঙ্গে আজ দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের খাসেরহাট মাদ্রাসাপাড়ার তাঁদের বাড়ির সামনে কথা হয়। আয়াতুল্লাহ বেহেস্তীও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ও বেকার জীবনযাপন করছেন বলে জানান তিনি। তাঁরা দুই ভাই ছিলেন। বাবা রফিকুল ইসলাম ২০১৩ সালে মারা গেছেন। মা ও তিনি বাড়িতে থাকেন। বাবা মাদ্রাসাশিক্ষক হওয়ায় তাঁরা দুই ভাই মাদ্রাসায় পড়ে দাখিল পাস করেন। বাবাও আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থক ছিলেন।
আয়াতুল্লাহ বেহেস্তী আরও বলেন, ‘২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আমার ভাইয়ের ওপর হামলা করে। ওই হামলায় তার এক পা কেটে বিচ্ছিন্ন ও এক পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো করে কেটে ফেলা হয়। শরীরে ছিল অসংখ্য ধারালো অস্ত্রের আঘাত। বাঁচার কথা ছিল না। বহুদিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিল। সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী আতিকুল্লাহ সুমন নামে একজন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় শিবিরের নেতা-কর্মীদের। এবারও শিবিরই মেরেছে বলে ধারণা। সেই মামলারই (২০১৪ সালের মামলা) বিচার সম্পন্ন হয়নি। মামলার শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তা–ও জানি না। আসলে হতাশ ছিলাম, খোঁজখবর করিনি।’
মামলা প্রসঙ্গে নিহত মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা বলেন, ‘আমার বড় ভাই (ভাশুর) এখন পরিবারের অভিভাবক। তিনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই চূড়ান্ত। তবে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এটা আমি চাই।’ একপর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, দেড় বছর আগে মাসুদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ৩ সেপ্টেম্বর তাঁদের মেয়ের জন্ম হয়। মাসুদ নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলেন মাসুমা। আকিকা করে এই নাম ঘোষণা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আগেই তো তিনি চলে গেলেন।
মাসুদের মা তাসেনুর বেগম বলেন, ‘একটা সুসংবাদ (নাতনির জন্ম) পেয়ে খুশিতেই ছিলাম। তার কদিন পরই ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। তাঁর পাঠানো টাকাতেই সংসার চলছিল। বড় ছেলে তো বেকার। এখন কী করে যে চলবে, ভেবে কুল পাচ্ছি না।’