ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানির সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন দুই দেশই তাদের সম্পর্কের উন্নতি করার উপায় খুঁজছে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শফিকুল ইসলাম: দেশের তুলনায় ভারতে দাম বেশি পাওয়ায় পাচার হচ্ছে ইলিশ। কোনোভাবেই পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ ট্রলার থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। এমন তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবসায়ী ও জেলেরা। অপরদিকে, সরকারের অনুমতি পাওয়ায় বৈধপথে ইলিশ রফতানি তো আছেই। এ বছর সরকার ৩ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির সুযোগ দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছোট-বড় যে কোনও আকারের ইলিশের চাহিদা রয়েছে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। আকার বড় হলে তো আর কোনও কথাই নাই। এ বছর ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ গ্রাম, আবার কখনও এক বা দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। এর প্রায় বেশিরভাগই রফতানি হয়ে চলে যাচ্ছে ভারতে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা জেলেদের জালে ধরা পড়া ইলিশ সাগর থেকে সংগ্রহ করে সেখানকার বাজারে তুলছেন। ইলিশের দাদন ব্যবসায়ীরা জেলেদের ট্রলার থেকে নিয়ে তা বেশি দামে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
এ ছাড়াও সুন্দরবন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থলবন্দর কাকদ্বীপ হয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ। ফলে দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না কাঙ্খিত ইলিশ। আর যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম চড়া। এক কথায় দেশের বেশিরভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সঙ্গে ইলিশ চলে যাচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলাসহ আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে। বাংলাদেশের মাছ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে বৈধপথে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে রুই, পাবদা, কৈ, শিংসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রফতানি হচ্ছে। এর সঙ্গে অবৈধভাবে রফতানি হচ্ছে ইলিশ। কার্টুনের উপরভাগে রুই, পাবদা, কৈ, শিং লেখা থাকলেও নিচে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে ইলিশ। স্থলবন্দরে চেকিংয়ে কড়াকড়ি না থাকায় পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা গেছে, বাজারে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি ইলিশ মাছের দাম ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি দরে। ইলিশের আকার-ওজন এক কেজির বেশি হলে তা বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা কেজি দরে।
অপরদিকে, রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বারাসাত ও হাওরা বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে ৯০০ গ্রাম থেকে ১০০০ গ্রাম বা এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার ২০০ রূপি দরে যা বাংলাদেশের মুদ্রায় ২ হাজার ৪৭০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮৬০ টাকা দরে। (ভারতীয় ১০০ রূপি বাংলাদেশের ১৩০ টাকা হিসেবে)।
একইভাবে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের বিভিন্ন বাজারে একই ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ রূপি থেকে ২ হাজার রূপি দরে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৩৪০ টাকা থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলকাতার ইলিশ ব্যবসায়ী সত্যজিৎ মহাজন জানিয়েছেন, কলকাতার বিভিন্ন বাজারে এখন ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সামনে দুর্গা পূজা থাকায় কলকাতায় ইলিশের এখন অনেক চাহিদা। তাই দাম মুখ্য নয়, ইলিশ পাওয়াটাই মুখ্য। এ কারণে আমরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গতবছরের তুলনায় অনেকটা বেশি দামে এবছর ইলিশ কিনছি। আমরা প্রতি কেজি ইলিশ কিনছি বাংলাদেশি টাকায় ১৬০০ থেকে সর্বোচ্চ ২২০০ টাকা দরে।
ত্রিপুরার মাছ ব্যবসায়ী হরিপদ রায় জানিয়েছেন, আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে মাছের প্যাকেট ধাক্কা মারলেও ত্রিপুরায় এসে পড়ে। কাজেই বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া আমাদের জন্য কোনও বিষয় নয়। তিনি জানান, গতবছরের তুলনায় এ বছর সব ওজনের ইলিশই ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে চাহিদা রয়েছে।
ত্রিপুরার অপর এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বৈধপথেই আখাউড়া থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ত্রিপুরা, আসাম এবং মেঘালয়ে আসছে। এর সঙ্গে স্থলবন্দরের দায়িত্বশীলদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বা তাদেরকে ম্যানেজ করে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ এখানে আসে। কাজেই বাংলাদেশের ইলিশ পেতে আমাদের তেমন কষ্ট করতে হয় না। দাম বেশি পায় বলে ওখানকার ব্যবসায়ীরাও আমাদেরকে ইলিশ পাঠায়। আমরা এবছর কিছুটা বেশি দামে ইলিশ কিনছি।
এ প্রসঙ্গে পিরোজপুরের ইলিশ ব্যবসায়ী মোকাররম হোসেন জানিয়েছেন, জেলেদের আমরা তাদের দুঃসময়ে দাদন দেই। দাদনের টাকা পরিশোধে জেলেরা আমাদেরকে তাদের ইলিশ দেয়। আমরা তা দেশের বাজারে সরবরাহ করি। কিন্তু এ বছর নানা কারণেই ইলিশ কম ধরা পড়ছে। ভরা মৌসুমেও কাঙ্খিত ইলিশ মিলছে না। এর উপরে ভারতে ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। দামও পাচ্ছি ভালো। তাই সেদিকেও রফতানি করছি। তিনি জানান, ভারতের ব্যবসায়ীরা সাগর থেকেই ইলিশ কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, দেশের বাজারেও গতবছরের তুলনায় এবছর ইলিশের সরবরাহ কম। তাই নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আসেনি ইলিশের দাম। আকার-ওজনের উপর নির্ভর করা এ মাছের দাম সব সময়ই সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে থাকায় ক্ষোভও প্রচুর। অপরদিকে অক্টোবরের ১৩ তারিখ থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরা, বাজারজাত, বিপণন বন্ধ থাকবে ইলিশের। এই ২২ দিন কেউ কাউকে উপহার হিসেবেও ইলিশ দিতে পারবেন না। এ সময় করা যাবে না ইলিশ সংরক্ষণ। এ কারণে বাজারে ইলিশ কম পাওয়া গেলেও কেনার সাধ্য নেই অনেকের। বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি ইলিশের দাম ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ৯০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি দরে। ইলিশের ওজন এক কেজির বেশি হলে তা বিক্রি হচ্ছে ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা কেজি দরে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাঁদপুরের ইলিশ ব্যবসায়ী লক্ষণ চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, কয়েকদিন পরেই মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা আসছে। সে কারণে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়েরই ইলিশের উপর আগ্রহ বাড়ছে। জেলেদের জালে যা ধরা পড়ছে তাই বাজারে সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। ২২ দিনের জন্য ইলিশ পাওয়া যাবে না ভেবে ক্রেতাও ইলিশ কেনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন। এতে বাড়ছে ইলিশের দাম। সরবরাহ কমের কারণেও এবছর ইলিশের দাম নামছে না।
বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির কারণে দেশের বাজারে দাম বাড়ার কোনও কারণ নাই। তিন হাজার টন ইলিশ চাঁদপুরে এক দিনের উৎপাদনও নয়। এটি ইলিশের বাজারে কোনও প্রভাব ফেলবে না।