পোশাক কারখানায় কাজ করছে এক নারী শ্রমিক | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
গোলাম মওলা: গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ার বেশিরভাগ তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন। ফলে কারখানায় উৎপাদন পুরোদমে শুরু হয়েছে। এখন শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যমুখর শিল্পাঞ্চল।
মঙ্গলবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সরকার-মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ায় আন্দোলন ছেড়ে কাজে ফিরেছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। তবে আর্থিক সংকটের কারণে এখনও কিছু কারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও কয়েক দিনের শ্রমিক আন্দোলনের মুখে বন্ধ ঘোষণা করা কারখানাগুলোও ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ কারখানাগুলোর মধ্যে বৃহস্পতিবার খুলে দেওয়া হয়েছে আরও ৫টি। এখনও বন্ধ থাকা ৯টি কারখানা শিগগিরই খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শিল্প পুলিশ।
কারখানা এলাকায় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কাজ করছে যৌথ বাহিনী। শিল্প এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজেপি সদস্যরাও টহল দিচ্ছেন। শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে মোট নিবন্ধিত কারখানা ২ হাজার ৬৩৩টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত কারখানা আছে ৫০০টি। এসব কারখানায় কাজ করেন প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক। শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে মালিকপক্ষ। ফলে বিক্ষোভ-প্রতিবাদসহ অন্য কর্মসূচি আপাতত বন্ধ করে কাজে ফিরেছেন শ্রমিকেরা।
তৈরি পোশাক মালিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানা চালু হওয়ায় বেশিরভাগ মালিক আপাতত খুশি হলেও অনেকেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। কারণ, বাস্তবে সব কারখানায় নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া অনেকেই এখনও কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণেও কিছু কারখানার মালিক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারখানা মালিক বলেন, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধে মালিকদের বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে না ব্যাংকগুলো। তিনি বলেন, 'ব্যাংকে টাকা নেই' অজুহাত তুলে ঋণ দেওয়া থেকে বিরত থাকছে ব্যাংকগুলো। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হলে হয়তো সৃষ্ট সমস্যা এত বড় হতো না।
প্রসঙ্গত, ১ সেপ্টেম্বর এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়, আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধে মালিকদের বিশেষ ঋণ সুবিধা দেবে ব্যাংকগুলো। কিন্তু বাস্তবে এই ঋণ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা ওই সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতা ঠিক রাখতে সচল রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য চলতি মূলধন ঋণসীমার বাইরে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে গ্রাহকের সক্ষমতা বিবেচনায় মেয়াদি ঋণ সুবিধা পাবে। ঋণের অর্থ মেয়াদি ঋণ আকারে তিন মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ এক বছরে সমকিস্তিতে (মাসিক/ত্রৈমাসিক) আদায় করতে পারবে ব্যাংক এবং এ ঋণের সুদ ছাড়া অন্য কোনও অতিরিক্ত সুদ, মুনাফা, ফি ও চার্জ নিতে পারবে না।
পোশাক কারখানার কয়েকজন মালিকের অভিমত, বর্তমান বাস্তবতায় বড় কারখানার পক্ষে শ্রমিকদের ১৮টি দাবিই মেনে নেওয়া সহজ। তবে ছোট ও মাঝারি পোশাক কারখানা মালিকদের পক্ষে সব দাবি মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য। তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিরাপত্তা ও আর্থিক কারণে এমনিতেই ছোট ও মাঝারি কারখানা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে। এমন বাস্তবতায় সব পোশাক কারখানার শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানোর ফলে বড় কারখানা মালিকদের কোনও সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়বেন ছোট কারখানার মালিকরা। একইভাবে অক্টোবরের মধ্যে সব কারখানায় সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হলে ছোট ও মাঝারি কারখানার অনেকেই এই খাত থেকে হারিয়ে যেতে পারেন।
এই প্রসঙ্গটি তুলে গার্মেন্ট মালিকদের বড় একটি অংশ বলছেন, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা দেওয়া হয়, সেটি এখনও সব কারখানায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ অবস্থায় আবার নতুন মজুরি বোর্ড গঠন ও তা বাস্তবায়ন সহজ নাও হতে পারে।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেছেন, বিগত সরকার নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমাদের ওপর যে মজুরি কাঠামো চাপিয়ে দিয়েছিল তা এখনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাহলে আবার নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের প্রসঙ্গ আসছে কেন।
অবশ্য মজুরি ও ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর বিষয়টি ছাড়া বাকি ১৬টি দাবি মোটামুটি বাস্তবসম্মত বলে জানিয়েছেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের একাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ব্যবসা করে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে থাকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ব্যবসা যখন কমে যায়, বা বন্ধ হয়ে যায় তখন সমস্যা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক সহযোগিতা করলে অনেকাংশে সমস্যার সমাধান হয়। ব্যাংক যদি সহযোগিতা না দেয় তখন সমস্যা বড় আকার ধারণ করে। এবার অনেকটা সে রকমই হয়েছে।
এক গার্মেন্ট মালিক বলেছেন, বিভিন্ন কারণে তাদের খরচ বেড়ে গেছে। সেই খরচ সমন্বয় করার জন্য দরকার নীতি-সহায়তা। তিনি মনে করেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও সরকারের নীতি-সহায়তা পেলে গার্মেন্ট খাতের নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতি আবার সচল হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শ্রমিকদের ১৮ দাবির মধ্যে ১৬টি কম-বেশি কারখানা মালিকরা আগে থেকেই মেনে আসছিল। মজুরি ও ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর যে দাবি যুক্ত হয়েছে, এগুলো বাস্তবায়নে আগে দেখতে হবে কারখানার সক্ষমতা। এক্ষেত্রে সরকার একটি কমিটি করবে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিষয়টি ফয়সালা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সব পক্ষের সমন্বয়ে অচিরেই সরকার একটি সক্ষমতা যাচাই কমিটি করবে। কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতারাও থাকবেন। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি অনেকের জন্য কষ্টসাধ্য হলেও আমরা মেনে নিয়েছি। অর্থনীতির চাকা যাতে সচল থাকে সেজন্য আমরা মালিক, শ্রমিক ও সরকার একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা আশা করছি মালিকদের সমস্যার সমাধানও অচিরেই হয়ে যাবে।
তিনি জানান, শ্রম মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে নীতি-সহায়তা ও কারখানার নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। মালিকরা কারখানার নিরাপত্তা চায়। উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ চায়। মালিকদের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন চায়। তিনি বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে এখনও অনেক প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক উৎপাদনে যেতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে স্বাভাবিক উৎপাদনে যেতে পারে সেজন্য দ্রুত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্ডার কমে যাচ্ছে, আস্থা হারাচ্ছেন ক্রেতারা। এতে সব পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়া জরুরি।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কারখানা চালুর পর মালিকদের চাওয়া-পাওয়া ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে। অচিরেই আমরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবো।
এখন আমরা উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে মনোযোগ দিচ্ছি। আর উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলে শ্রমিকরা কাজের মধ্যে থাকবে। উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় মনোযোগ দেবে। উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকবে।
এর আগে মঙ্গলবার সচিবালয়ে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দেশের শিল্পকে বাঁচানোর স্বার্থে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। অক্টোবরের মধ্যে সব কারখানায় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার উপস্থিত ছিলেন।
শ্রমিকদের দাবিগুলো হলো—১. মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনপূর্বক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ২. যেসব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি সেগুলোতে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ৩. শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। ৪. কোনও শ্রমিকের চাকরি পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে অথবা চাকরিচ্যুত হলে একটি বেসিকের সমান অর্থ দিতে হবে। এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্য ধারাগুলো সংশোধন করতে হবে। ৫. সব ধরনের বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে। ৬. হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সব কারখানায় সমান হারে বাড়াতে হবে। ৭. সব কারখানায় প্রভিডেন্ট ফান্ড ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ৮. বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। ৯. শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ১০. বিজিএমইএ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা যাবে না, বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ১১. সব ধরনের হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। ১২. ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, প্রয়োজনে এ বিষয়ে আইন করতে হবে। ১৩. কলকারখানায় বৈষম্যবিহীন নিয়োগ দিতে হবে। ১৪. জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। ১৫. রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্তের পর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৬. শ্রম আইন অনুযায়ী সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। ১৭. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। ১৮. নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ করতে হবে।