● পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ কর্মস্থলে যোগ দিয়েই নানা কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন।
● শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। তাঁরাও আত্মগোপনে ছিলেন।
পুলিশের লোগো |
মাহমুদুল হাসান: আগস্টের ৫ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৭ জন সদস্য এখনো কর্মস্থলে যোগ দেননি। এ তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরের। তবে এর বাইরেও অনেক পুলিশ সদস্য নানা কৌশলে বা কারণ দেখিয়ে কর্মস্থলে এখনো অনুপস্থিত রয়েছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতার দাপট দেখানোসহ নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়া পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এখন আর প্রকাশ্যে আসছেন না। তাঁদের কেউ কেউ কর্মস্থলে যোগ দিয়েই নানা কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন। অনেকে আবার কাজে যোগ দেওয়ার পর ছুটি না নিয়েই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। গত ৫ আগস্টের পর কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া পুলিশ সদর দপ্তরের করা ১৮৭ জনের তালিকায় তাঁদের নাম নেই। পুলিশের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
গ্রেপ্তার এড়াতে পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। আবার কেউ শিক্ষা ছুটি, কেউ অসুস্থতার কথা বলে কিংবা লিয়েন (অনুমোদন নিয়ে অন্যত্র চাকরি) নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
পুলিশের পক্ষ থেকে আত্মগোপনে থাকা কর্মকর্তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তবে ১৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, লুকিয়ে আছেন, তাঁদের আর যোগ দিতে দেওয়া হবে না। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিশ্চয়ই তাঁরা কোনো অপকর্মে জড়িত, এ কারণে কাজে যোগ দিচ্ছেন না। এমন পুলিশ সদস্যের সংখ্যা নগণ্য। তাঁদের বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অপরাধ তদন্ত বিভাগের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামানসহ শীর্ষ পর্যায়ের অন্তত ২৩ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। অবসরে যাওয়ার আগে তাঁদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে ছিলেন।
গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলির ঘটনায় পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন মামলা হচ্ছে। এসব মামলায় পুলিশের সাবেক দুই মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হক, অতিরিক্ত ডিআইজি মশিউর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহিল কাফী ও যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচিত অন্তত সাত সদস্যকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের অনুমতি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পুলিশের আট কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, ঢাকার সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহিদুর রহমান, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী। অবশ্য গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়ার আগেই ২ সেপ্টেম্বর রাতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ডিবি পুলিশ কাফীকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়া পুলিশ সদস্যের তালিকায় আরও আছেন ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, ওয়ারী জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার এস এম শামীম, উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. তৌহিদুল ইসলাম ও ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সাবেক সহকারী কমিশনার তানজিল আহমেদ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উত্তরার সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানার সাবেক ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম। রফিকুলকে ২২ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়।
ওই আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশের কমপক্ষে ৯৯ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
আত্মগোপনে যাঁরা
কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া ১৮৭ সদস্যের যে তালিকা পুলিশ সদর দপ্তর দিয়েছে, এর মধ্যে ডিআইজি থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৬ জন। পুলিশ পরিদর্শক আছেন ৫ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৪ জন। অন্যদের মধ্যে এএসআই ৯ জন, নায়েক ৭ জন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান (স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসরের আবেদন করেছেন), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী ও সঞ্জিত কুমার রায়, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
পুলিশ সুপার থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আত্মগোপনে থাকা অন্য আট কর্মকর্তা হলেন আরপিএমপির উপকমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপির ডিবির উপকমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সাবেক এডিসি মো. রওশানুল হক, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার জন রানা।
পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির সাবেক পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
অনুপস্থিত বা আত্মগোপনে থাকা সদস্যদের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ইনামুল হক গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, কর্মস্থলে অনুপস্থিত ১৮৭ জনের আর যোগ দেওয়ার সুযোগ নেই। কাজে যোগ দেওয়ার পর অফিস করছেন না, এমন সদস্যদের তালিকা করা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে পুলিশ সদর দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, এ–সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো নেই। যাঁরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না কিংবা যোগ দিয়ে কর্মস্থলে আসছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, তা তদন্ত করা হবে।