১৭ বছরের মামলা নিষ্পত্তির তোড়জোড় বিএনপিতে

বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত দেড় যুগে দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত সুরাহা করতে চায় বিএনপি। এজন্য ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া সব মামলার তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে দলটি। আগামীকাল রোববারের মধ্যে এসব তথ্য চেয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে বিএনপির জেলা ও মহানগর শাখার নেতাদের কাছে।

বিএনপি নেতাদের দাবি, গত সাড়ে ১৭ বছরে দেড় লাখের বেশি মামলায় তাদের ৬০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে শুরু করে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তো বটেই, একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এমনকি সমর্থকরাও মামলা থেকে রেহাই পাননি। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলকে দমন করতে এসব মামলা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, ২০০৭ সাল থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো মিথ্যা, গায়েবি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এসব মামলা প্রত্যাহার হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।

দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন করে দল গোছানোর কাজ শুরু করেছে বিএনপি। এর মধ্যেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নেতাকর্মীদের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্বাচনের আগেই নেতাকর্মীরা যেন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা ও নির্বিঘ্নে রাজনীতি করার সুযোগ পান, মূলত সেজন্যই দ্রুততম সময়ে তাদের মামলা নিষ্পত্তির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনো দেশের বাইরে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তার সব মামলা প্রত্যাহার করা দরকার। খালেদা জিয়ার মামলাও প্রত্যাহার করা দরকার। বিএনপি মহাসচিবসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মী যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, তাদের মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। এই মামলাগুলো যতক্ষণ না প্রত্যাহার করা হবে, ততক্ষণ প্রশ্ন থেকেই যাবে যে—অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ শুরু করেছে কি না।’

তৃণমূলের কাছে যেসব তথ্য চেয়েছে কেন্দ্র

দলের জেলা ও মহানগরের নেতাদের কাছে তথ্য বিবরণী চেয়ে বিএনপির পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী দুঃশাসন প্রলম্বিত করতে ব্যাপক উৎপীড়ন-নিপীড়নের অংশ হিসেবে ২০০৭ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

চিঠিতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো—উল্লিখিত সময়কালে রুজুকৃত মিথ্যা মামলার বিবরণ (সংযুক্ত ছকে বর্ণিত তথ্যাদি) আগামী সাত দিনের মধ্যে (২ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী সাত দিন) কেন্দ্রীয় দপ্তরে জমা দিতে হবে, জেলা ও মহানগরের সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের (সংযুক্ত ছক অনুযায়ী) মামলার তথ্য বিবরণী বিএনপির সঙ্গে সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেরণ করতে হবে এবং জরুরিভিত্তিতে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে (সংযুক্ত ছক অনুযায়ী) মামলার তথ্য বিবরণী কেন্দ্রে পাঠাতে হবে।

চিঠির সঙ্গে ‘বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রাজনৈতিক মামলার তালিকা’ শীর্ষক মামলার বিবরণীর একটি নমুনা ছক পাঠিয়ে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো—থানার নাম ও মামলা নং/জি আর নং (মামলা দায়েরের তারিখ) এবং বিচারাধীন মামলার নং, মামলার ধারা, বিচারাধীন আদালতের নাম, আসামির সংখ্যা এবং মামলার বর্তমান অবস্থা (চার্জশিট বা চার্জ গঠন হয়েছে কি না অথবা ট্রায়ালে আছে কি না)। মামলার তথ্য জোগাড় ও যাচাই এবং ফরমটি পূরণ করার জন্য নিজ নিজ জেলা আইনজীবী ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, বিগত ১৬-১৭ বছরে সারা দেশে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা, গায়েবি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলা দেওয়া হয়েছে। দলের কাছে এর হালনাগাদ তথ্য থাকা দরকার। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য সেটা সরকারকে দেওয়া হবে। দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এটা প্রয়োজন।

তথ্য সংগ্রহের পর কী করবে বিএনপি

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেলেও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিএনপির সারা দেশের নেতাকর্মীরা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছেন আদালতের বারান্দায়। এখনো তাদের হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কিছু মামলায় দ্রুত রায় ঘোষণা হয়েছে। সে সময় দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মী দণ্ডিত হয়েছেন। অবশ্য নির্বাচনের পর আইনি প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ নেতা কারামুক্তও হয়েছেন। তবে এখন মামলা প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের নেতাকর্মীদের মামলার তথ্য বিবরণী পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বিএনপি। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরে মামলার এই হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব মামলা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তা অন্তর্বর্তী সরকারকেও দেওয়া হবে। বিএনপি মনে করে, দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার হওয়া প্রয়োজন।

বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পাইকারি হারে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহে গত ২ সেপ্টেম্বর দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে জেলা ও মহানগর শাখায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের নেতাকর্মীদের মামলার সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহের পর দল পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।

মামলা নিষ্পত্তি হতে পারে যেভাবে

নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছরে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মিথ্যা, গায়েবি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেগুলো বর্তমানে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন। দুই ধরনের মামলাই প্রত্যাহার করা যেতে পারে। তদন্তাধীন মামলায় ভালো প্রক্রিয়া হলো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দেওয়া। তারপর বৈষম্যবিরোধী

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে হওয়া মামলাগুলো সম্প্রতি যেভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বিচারাধীন মামলার আসামিরা পাবলিক প্রসিকিউটরের মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ নির্দেশ দান করলে আদালত থেকে মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আদালত মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে তদন্তাধীন ও বিচারাধীন সব মামলা একসঙ্গেও প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।’

১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা মামলায় বিচারাধীন এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে মোকদ্দমা পরিচালনা থেকে সরে যেতে পারেন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি)। তবে এর জন্য আদালতের অনুমতি নিতে হবে। চার্জ গঠনের আগে প্রত্যাহার হলে আসামি অব্যাহতি পাবেন। আর চার্জ গঠনের পর হলে আসামি খালাস হিসেবে গণ্য হবেন।