মামলায় নানা অসংগতি, মনগড়া এজাহার

মামলা | প্রতীকী ছবি

সাহাদাত হোসেন পরশ, ইন্দ্রজিৎ সরকার ও আবদুল হামিদ: দেশের বাইরে থেকেও কেউ কেউ ‘ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে গুলি ছুড়ে’ হয়েছেন অভিযুক্ত। দুই স্থানে একই সময়ের ঘটনায় করা আলাদা মামলায় উঠেছে অভিন্ন আসামির নাম। কিছু মামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আসামি হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীর নামও। প্রতিপক্ষ ঘায়েলে ইচ্ছা করেই নাম ঢোকানো হয়েছে কোনো কোনো মামলায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পটভূমিতে করা বেশ কিছু মামলার এজাহার ঘেঁটে এমন নানা অসংগতি পেয়েছে প্রতিবেদক। যেমন খুশি তেমন মনগড়া মামলায় আসামি হয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন নিরপরাধ অনেক ব্যক্তি। এমনকি মামলায় জড়িয়ে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এসব কারণে কিছু মামলার এজাহার হয়ে গেছে বেশ দুর্বল।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এসব অসংগতি ও কমজোরি এজাহারের কারণে অভিযোগের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ কারণে সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে পারে ভুক্তভোগী পরিবার।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী-এমপি ও দলের নেতাকর্মীর নামে এ পর্যন্ত ২৬৮ মামলা হয়েছে। শুধু শেখ হাসিনার নামেই হয়েছে ১০০ মামলা। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করা হয়েছে ২৬ হাজার ২৬৪ জনের। একই সঙ্গে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জনকে। বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) আগস্টের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলি ও সহিংসতায় গত ১৬ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে অন্তত ৭৫৮ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শিক্ষার্থী, শিশু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন।  

এ ব্যাপারে সাবেক পুলিশপ্রধান মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, ‘অভিযোগের ব্যাপারে সন্দেহ থাকলে জিডি করে সত্যাসত্য নিরূপণ করে মামলা নেওয়া যেতে পারে। এজাহার মূল্যবান সাক্ষ্য। তবে পরে যদি প্রমাণ হয় ঘটনা সত্য নয়, তাহলে অভিযোগপত্রে অভিযুক্তকে বাদ দিতে হবে।’

সাকিব তখন কানাডায়
৫ আগস্ট রাজধানীর আদাবরে পোশাক শ্রমিক মো. রুবেলকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়। সেই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকার ২৮ নম্বরে রয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার ও সাবেক এমপি সাকিব আল হাসান। এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনিসহ অন্য আসামিরা ঘটনাস্থলে থেকে গুলি ছুড়লে রুবেল প্রাণ হারান। অথচ ২ জুলাই ক্রিকেট লিগ খেলতে যুক্তরাষ্ট্রে যান সাকিব। ৫ আগস্ট তিনি কানাডায় গ্লোবাল টি২০ লিগ খেলছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেননি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনও সেদিন দেশে ছিলেন না। তাঁকেও একইভাবে অভিযুক্ত করা হয়।

এজাহারে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর আঘাত, নারীর শ্লীলতাহানি ও গণহত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। অথচ সেদিন ধানমন্ডির ওই কার্যালয়ে এমন কোনো বৈঠক বা আলোচনা হয়নি। পরিকল্পনাকারী হিসেবে সাকিব ছাড়াও শেখ রেহানা, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, চিত্রনায়ক ও সাবেক এমপি ফেরদৌস আহম্মেদসহ ৭৫ জনের নাম রয়েছে। যদিও তারা সেদিন ওই কার্যালয়ে গেছেন– এমন তথ্য মেলেনি। শেখ রেহানা তখন দেশে ছিলেন না। আর ১৪ দলের বৈঠক না থাকায় আওয়ামী জোটের শরিক দলের নেতাদের যাওয়ার কোনো কারণও ছিল না। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী দীর্ঘদিন দলের কোনো পদে নেই। ফলে ধানমন্ডির কার্যালয়ে সেভাবে তাঁর যাতায়াতও ছিল না। সাবেক এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহও সেদিন দেশে ছিলেন না বলে দাবি সংশ্লিষ্ট সূত্রের। আলোচিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের বিরুদ্ধেও ঘটনাস্থলে থেকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনিও দেশে ছিলেন না বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে।

চিটাগং রোড থেকে আদাবর

৫ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ীর চিটাগং রোডে ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ইমন হোসেন গাজী। এ ঘটনায় তাঁর ভাই আনোয়ার হোসেন গাজীর করা মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সঞ্জীব কুমার রায়, সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামান, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানসহ ৮৫ জনকে। এসব পুলিশ কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগ নেতাকে আদাবরের রুবেল হত্যা মামলায়ও আসামি করা হয়েছে। ওই মামলায় বেলা ১১টায় মিছিল বের করার কথা বলা হয়। আর মিছিলটি কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর গুলির ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে আদাবরে গুলি-সংঘর্ষের পর অল্প সময়ের মধ্যেই অভিযুক্তদের চিটাগং রোডে গিয়ে আবার গুলি ছোড়ার বিষয়টি যৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের।

ব্যবসায়িক অংশীদারকে মামলায় ঘায়েল!
শেরপুরের তাড়াগড় কান্দারপাড়ার মাহফুজা বেগম ছেলে মাহবুব আলমের মৃত্যুর ঘটনায় ১২ আগস্ট স্থানীয় থানায় মামলা করেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ৪ আগস্ট শেরপুরে ছাত্র-জনতার মিছিল হয়। বিকেল ৩টার দিকে সাবেক এমপি ছানোয়ার হোসেন ছানু ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির পিস্তল, শটগানসহ তাদের ৩০০-৪০০ সহযোগী নিয়ে আন্দোলনকারীকে ধাওয়া করেন। তারা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন। এতে প্রাণভয়ে পালানোর সময় ম্যাজিস্ট্রেট বহনকারী একটি পিকআপের অজ্ঞাতনামা চালক হত্যার উদ্দেশ্যে মাহবুব ও সৌরভ নামে দু’জনকে চাপা দেয়। দু’জনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রথম মামলায় দু’জনের নামসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করা হয়। পরে ১৯ আগস্ট একটি সংশোধিত এজাহার দেন মাহফুজা। সেখানে তিনি ৮১ জনের নাম ‘আসামি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনকে অভিযুক্ত করেন।

মামলাটির এজাহার ঘেঁটে দেখা যায়, হত্যাসহ পেনাল কোডের আরও কিছু ধারা যুক্ত করে পরে যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেকে গত এক দশকেও শেরপুর যাননি। তারা রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত নন। তাহলে কীভাবে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় তারা আসামি হলেন! মাহফুজার মামলায় ৬৫ নম্বর আসামি টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ হোসেন। পিউর কেমিক্যালের কর্ণধার তিনি। ফরহাদের গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগর। এখন থাকেন রাজধানীর উত্তরায়। ওই মামলার ৬৪ নম্বর আসামি ফরহাদের বন্ধু ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। ইলিয়াস  বলেন, ‘কয়েক দিন আগে পুলিশ আমার ভাইকে ফোন করে। তখন মামলার কথা জানতে পারি। হত্যা মামলার আসামি– এটি শুনে আমি অবাক। কেন আসামি হয়েছি, সেটা বুঝতে পারছি না।’ ফরহাদ বলেন, ‘আসামি হওয়ার পেছনে আমার সাবেক এক ব্যবসায়িক অংশীদারের হাত থাকতে পারে। তাঁর কাছে আড়াই কোটি টাকা পাব। তাঁর বাড়ি শেরপুর সদরে। কাউকে ম্যানেজ করে সে এখন মামলায় ফাঁসাতে পারে। মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে, বাবা, আমি শুধু সই করেছি। আসামির কথা জানি না।’

নেপালে থেকেও আসামি জয়
২০১৫ সালের ২০ এপ্রিল নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় বিএনপি কার্যালয়ের সামনে খালেদা জিয়াকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সম্প্রতি একটি মামলা হয়েছে। ব্যান্ডশিল্পী আসিফ ইমামের করা মামলায় চিত্রনায়ক জায়েদ খান, অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয়, সাজু খাদেমসহ ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

৯ বছর আগের ওই ঘটনায় এতদিন রাজনৈতিক নেতাকর্মী ছাড়া অভিনয়শিল্পীদের নাম আসেনি। তাই এত বছর পর এ অভিযোগকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন অনেকে।

এক ভিডিওবার্তায় জয় বলেন, ‘১৫ এপ্রিল আমি শুটিংয়ের কাজে নেপালে ছিলাম। আমার পাসপোর্টেও বিষয়টি উল্লেখ আছে। সেদিন বেলা ১১টার ফ্লাইটে নেপালে যাই। সে সময় নেপালে একটি বড় ভূমিকম্প হয়। যে ভূমিকম্পে আমি, রুনা খানসহ অনেক তারকা আটকা পড়ি। এরপর ২৬ এপ্রিল আমরা দেশে ফিরে আসি। সেই কাগজপত্র আমার কাছে আছে।’

জায়েদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। হতে পারে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলে বিশ্বাসী আমি। এ জন্য তো যে কেউ মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করতে পারে না।’

১৫ পুলিশ হত্যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী আসামি
গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৫ পুলিশ সদস্যকে হত্যার মামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুল্লুক চাঁন, বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়া প্রমুখ।

আলোচিত এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে আসামি করা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের চেষ্টার সময় পুলিশের পাশেই ছিলেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা পুলিশের সঙ্গে মিলে আন্দোলনকারীর ওপর হামলা করেছেন, গুলি চালিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তারা কেন থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশকে হত্যা করবেন?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। কীভাবে কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেব।

গাজীপুরে প্রবাসী অধ্যাপকও আসামি
গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় হওয়া চারটি মামলায় পাঁচ বিএনপি নেতাকর্মী ও বিদেশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও আসামি করা হয়েছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা ও দলীয় সুযোগ-সুবিধা নিতে নেতাকর্মীর নাম মামলায় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক এজাহার লিখে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছে পাঠিয়ে মামলা থেকে বাঁচানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনেরও অভিযোগ উঠেছে।

গাজীপুরের কয়েকটি থানায় চারটি মামলায় ৩৫১ জন নমীয় আসামি। অজ্ঞাত আসামি ১ হাজার ৫৫০ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাকর্মী রয়েছেন ৯৪ জন। একটি মামলায় তিন পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন।

বিভিন্ন মামলায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে ওয়ার্ড নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য ও গাছা থানা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মশি এবং গাছা থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বিল্লাল হোসেন মামলামুক্ত। তারা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের টাকা দিয়ে মামলা থেকে বেঁচেছেন।

এদিকে বাসন থানার ১৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিনহাজের নামে কোনো মামলা হয়নি। তিনি স্থানীয় বিএনপিকে ম্যানেজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে ঘটনাস্থল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শেখের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। নুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে পরিবার নিয়ে দেশে আসি। এসব সংঘর্ষের কোনো কিছুই জানি না। কোটাবিরোধী আন্দোলনে সংঘর্ষে মারা যাওয়ার ঘটনায় গাজীপুরের গাছা থানার এক মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে।

নুরুল ইসলাম বলেন, মামলার বাদী আমাকে চেনেন না, আমিও তাঁকে চিনি না। এখানে আমার নাম-পরিচয়সহ মামলায় ৫০ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

একই মামলার ৭০ নম্বর আসামি সাবেক ছাত্রদল নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, আমি জয়দেবপুর ১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম। ২০১২ সালের পর ব্যবসায় মনোযোগী হই। আমার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার পরও কীসের জন্য আমার নামে হত্যা মামলা হলো সেটা জানি না।

গাজীপুর গাছা থানায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে ২৪ আগস্ট হত্যা মামলা করেন ইনছার আলী। সেই মামলায় আসামি নুরুল ইসলাম শেখ ও জাহাঙ্গীর হোসেন। ইনছার আলী বলেন, শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালের নামে মামলা করেছি। তাদের নির্দেশে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো আসামিকে আমি চিনি না, জানি না। পুলিশ কার নাম দিয়েছে, তাও আমার জানা নেই।

হত্যার মামলার বাদীর এমন বক্তব্যের পর গাজীপুর গাছা থানার সেই মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে বাদী ইনছার আলী উল্লেখ করেছেন, গত ২০ জুলাই দুপুরের দিকে আমার ছেলে রাজমিস্ত্রি মঞ্জু মিয়াকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ২৪ আগস্ট গাছা থানায় হত্যা মামলা হয়। সেই মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাহিদ আহসান রাসেল, টিপু মুনশি, সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদসহ ৮৫ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। এজাহারে ৩৬ জন আসামির দলীয় পদ-পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

গাছা থানার আরেকটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য ও ব্যবসায়ী ফারুক হোসেনকে। এ বিষয়ে বাদী রজ্জর আলী বলেন, শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়া কারোর নামে মামলা করিনি। আসামি ফারুক হোসেন বলেন, গাজীপুর মহানগরের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে দীর্ঘদিন মনোমালিন্য রয়েছে। এ জন্য গাছা থানার হত্যা মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে আসামি করা হয়েছে। মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করে গাছা থানার ওসি জুয়েল ইসলাম  বলেন, এটা সত্য নয়। বাদী যাদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাদেরই আসামি করা হয়েছে। তবে বাদী এজাহারের প্রথম সারির কয়েকজনকে চিনলেও বাকিদের চেনেন না– এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি কোনো মন্তব্য করেননি।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) জিয়াউল হক বলেন, তদন্তে যেটা আসবে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সেই অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন জমা করবেন। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যকে ভুয়া মামলার বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

দুই এজাহারের অভিন্ন গাঁথুনি
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার দুটি হত্যা মামলার এজাহার প্রায় অভিন্ন। মামলা দুটিতে আসামি করা হয়েছে ফকির গ্রুপের তিনজনকে। তারা হলেন ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামান নিয়াজ এবং ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ। উভয় মামলায় ঢাকার বাইরের একজন পরিবহন ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়। দুটি মামলার একটি  বিএনপিকর্মী সফিকুল ইসলাম হত্যার। তাঁকে ১৯ জুলাই কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সফিকুলের স্ত্রী তাছলিমা আক্তার বাদী হয়ে ২১ আগস্ট এ মামলা করেন। ওই মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।